১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ‘সিমলা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে এটি ছিল একটি অসামঞ্জস চুক্তি। উপমাহাদেশে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠান জন্য পাকিস্তান-ভারত ও বাংলাদেশ এই তিন দেশকে নিয়ে একটি “ত্রি-দেশীয় চুক্তি” হওয়া দরকার ছিল। কারণ, প্রথমত, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় কেবলমাত্র বাংলাদেশেই গণহত্যা, নিষ্ঠুরতা, মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। তাই ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতেই হওয়া দরকার ছিল আর এটা আপামর জনগণেরও দাবি ছিল। দ্বিতীয়ত, ওই সময় বাংলাদেশে আটকা পড়া প্রায় আড়াই লাখ পাকিস্তানীর পাকিস্তানে দ্রুত প্রত্যার্বতনের দরকার ছিল। তৃতীয়ত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় দশ লক্ষ বাংলাদেশী পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল। মানবিক ও রাজনৈতিক কারণে তাদেরকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনা দরকার ছিল। চতুর্থত, বাংলাদেশ যুদ্ধ পূর্বে অবিভক্ত পাকিস্তানের নিকট ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ পাওনা আছে, যা পাওয়ার দাবি রাখে। পঞ্চমত, পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রায় ৯০ লাখ টাকা পাওনা আছে, যা পাওয়ার দাবি রাখে। ষষ্ঠত, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জমাকৃত প্রায় ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার, যা যুদ্ধকালীন সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান শাখায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, এটাও পাওয়ার দাবি রাখে।
কিন্তু ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের এসব ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবিকে ক্ষুন্ন করে তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সিমলা চুক্তি সম্পাদন করে নেয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান জম্মু ও কাশ্মীরের সীমান্তরেখাকে লাইন অব কট্রোল হিসেবে চিহিৃত করে এবং পাকিস্তান অধিকৃত ভারতীয় ভূখন্ড পাকিস্তানকে ফেরত দেওয়া হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হয় এবং ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ তৈরি হয়। ভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান কোনো সমস্যা সমাধানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা থেকে দুই দেশই বিরত থাকার অঙ্গীকার করে। এছাড়াও ভারত ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর অঙ্গীকার করে।
প্রসঙ্গত, সিমলা চুক্তি সম্পাদনকাল পর্যন্ত জাতিসংঘ, ইসলামি রাষ্ট্র সংস্থা, পাকিস্তানসহ প্রায় ৫০টি দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে কোনো ধরনের স্বীকৃতি দেয়নি। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি জটিল সমস্যা, তাই বাংলাদেশ সরাসরি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধপরবর্তী প্রয়োজনীয় ও দুর্বোধ্য সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে তেমনকোনো আলাপ করতে পারছিলো না। এমতাবস্থায় ভারতীয় প্রতিনিধি পি. এন. হাকসার ও ডি. পি. ধরের মাধ্যমে সংলাপ আদান-প্রদান করা হচ্ছিল।
উল্লেখ্য, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধবন্দী ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধ অপারধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার গণমানুষের প্রাণের দাবি ছিল। বিচারের সুবিধার্থে ৯৩ হাজার যুদ্ধঅপরাধীর সংখ্যা কমিয়ে ১৫০০-তে স্থির করা হয়। পরে পাকিস্তানের আপত্তিতে তা ১৯৫ তে কমিয়ে আনা হয়। পাকিস্তানী যুদ্ধঅপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের আদালতে করার জন্য ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে সংবিধান সংশোধন করে “যুদ্ধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধ দমনের আইন” প্রনিত হয় এবং উক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর বিচারের প্রত্যয় অব্যাহত রেখে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ যোগাড় শুরু করে। কিন্তু এই বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার অভিপ্রায়ে পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানে আটকাপড়া দশ লক্ষ বাংলাদেশীদের মধ্য থেকে বাছাই করে সামরিক ও বেসমরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে দেশদ্রোহী, গুপ্তচড়, দালালীর অভিযোগে বিচারের মু্খোমুখি করার হুমকি দিতে থাকে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকার আপাতত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে এবং এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ভারতকে প্রদান করা হয়।
এই গোলমেলে অবস্থা থেকে বের হয়ে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ১৮ আগস্ট পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা দিল্লীতে ভারতীয় প্রতিনিধির সাথে মিলিত হন। এখনে আলোচনা চলে একনাগাদ ১০ দিন পর্যন্ত। উক্ত আলোচনার পর ভারত-পাকিস্তানের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের মধ্য থেকে বাছাই করে কিছু সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পাকিস্তানে ফেরত নেওয়া হয়। কিন্তু বাকি প্রত্যাগমন ইচ্ছুদেরকে নেওয়া হয়নি! সেই আটকে পড়া পাকিস্তানীদের সংখ্যা বর্তমানে বিশ লাখে ছাড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানে আটকা পড়া দশ লাখ বাংলাদেশীদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক মানুষ যুদ্ধের পর বাংলাদেশে ফিরে আসেন, তবে অনেকেই পাকিস্তানে থেকে যান। আর ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে পাকিস্তানের আদালতে যুদ্ধ অপারাধের বিচার করা হবে বলে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তাদের বিচার পাকিস্তানের আদালতে আজ পর্যন্তও অনুষ্ঠিত হয়নি! এছাড়াও পাকিস্তান সরকারের নিকট পাওনা টাকা ও সম্পদের বিষয়টি স্থাগিত করা হয়!
ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান-ভারতই লাভবান হলো আর বাংলাদেশকে শূন্য হাতে ফিরে আসতে হলো। বস্তুত, ১৯৭১ সালের ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী ছিল পাকিস্তা-ভারত ও বাংলাদেশ-এই দেশের মধ্যে পারস্পারিক শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার ‘তুরুপের তাস’ স্বরূপ, কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো বাংলাদেশ সেই অতিরিক্ত সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। মূলত বাংলাদেশের কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দায়ি। এছাড়াও সিমলা চুক্তিতে ভারত-পাকিস্তান মিলিতভাবে বাংলাদেশের সাথে বিমাতা সুলভ আচরণ করেছে।
জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, আগ্রাসন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও যুদ্ধবন্দীর সুরক্ষার কাজ কেবলমাত্র ক্ষাতগ্রস্ত ও বিজয়ী দেশ তা সুম্পন্ন করতে পারে, অন্য কোনো দেশ নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাংলাদেশকে কৌশলে বিভিন্ন চুক্তির ফাঁদে ফেলে দালিলিকভাবে ভারত এই দায়িত্ব নিয়ে নেয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাপকভাবে এক ত্রিমুখী প্রত্যাবাস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিমলা চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হয় এবং ১৯৭৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, বাংলাদেশ সিমলা চুক্তিতে কোনো পক্ষ না হয়েও ভারতের মাধ্যমে তাকে চুক্তির বিভিন্ন শর্তগুলোতে স্বীকৃতি প্রদান করতে হয়েছে এবং চুক্তিতে স্বাক্ষরদাতা না হয়েও বাংলাদেশ ছিলো চুক্তি স্থাপনকারীদের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা ছিলো বাংলাদেশের জন্য একটি অবমাননা কর চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের আধিপত্যবাদের নগ্ন চিত্র ফুঁটে ওঠেছে। (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized