
বাঙালি জাতির রয়েছে অনন্য বীরত্বের সঙ্গে অনেক বিজয় অর্জন করতে পারার ইতিহাস। এটি আমাদের গর্ব। কিন্তু গভীর বেদনা ও পরিতাপের কথা হচ্ছে, সে ইতিহাসে একই সঙ্গে রয়েছে অর্জিত বিজয় ধরে রাখতে না পারারও ইতিহাস। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে অভূতপূর্ব বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারার পরেও মানুষের মাঝে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে কারণেই সংশয়।
মূলত জুলাই-আগস্টের অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনে পুরো জাতি সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্য রচনা করেছিল। জনগণের এই সুদৃঢ় ঐক্য ও সংহতির জন্যই বিগত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়েছিল। এমন সুদৃঢ় ঐক্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। মাত্র পাঁচ মাস আগে ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের জন্য রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় পরিচয়, পেশাগত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পরিচয় ভুলে সবাই রাজপথে নেমে এসেছিলেন।
এই জাতিয় ঐক্য তৈরির এক মাসের কম সময়ের মধ্যে প্রাণ দিতে হয়েছে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে। অন্ধ কিংবা পঙ্গু হয়েছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ। এই ঐক্য ফ্যাসিস্ট ও তার প্রধান দোসরদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ১৮ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো পুরোটাই রয়ে গেছে। হাসিনার পতন ও পলায়নের পর রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়া জন্য সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের ভোটকেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনৈতির প্রতিযোগিতার কারণে পাঁচ মাসের মাথায় আবার বিভক্তি ও বিভাজনের রাজনীতি ফিরে আসার আলামত দেখা যাচ্ছ।
এমনকি তাদের মধ্যে কিছু কিছু নেতাকর্মী ব্যক্তিস্বার্থের বিনিময়ে পতিত ফ্যাসিবাদের দোসর অপরাধীদের সুরক্ষায় বর্ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে!! এটা দিবালোকের মতো সত্য যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জুলাই বিপ্লবের চেতনা দিন দিনই লোপ পাচ্ছে এবং ঝোপ বুঝে কোপ মারার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এহেন আচরণ দুঃখজনক ব্যাপারও বটে!
উল্লেখ, গত দেড় দশকে ফ্যাসিস্ট শাসক টিকে ছিল জাতিকে বিভক্ত করার এক বয়ান থেকে। এটি ছিল চেতনার নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ করে জাতিকে বিভক্ত করা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ইসলামোফোবিয়া, গুম, খুন, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজী। ওই সময় আওয়ামী ও তাদের লেজুড় বামপন্থী-ভারতপন্থী ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া সবাই ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। যারা সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এমনকি তাদের বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বহু সাধারণ মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। সমাজে এমন একটি আবহ তৈরি করা হয়েছিল ভারত তথা আওয়ামী লীগ বিরোধী ও ইসলামী দর্শনে বিশ্বাসী যেকোনো ব্যক্তিকে হত্যা বা নির্যাতন করার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। এই আবহ শুধু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তৈরি করেছেন, তা নয়। এর সঙ্গে জড়িত ছিল দেশের শিক্ষিত সমাজ, গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী, আমলা, ব্যবসায়ী, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কথিত বুদ্ধিজীবীরা।
তবে এখন গণদাবি হচ্ছে, যে করেই হোক ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচারের এজলাসে দাঁড় করানো এবং যথাবিহিত প্রাপ্য বিচার নিশ্চিত করা। বিচার হাসিনা ও তার সহযোগীদের হবেই হবে, এটা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মতো অনিবার্য। এটা বিশ্বে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। স্বৈরাচার ধ্বংস করেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসন, লুটেছে অর্থনীতি, ইতিহাসে সর্বাধিক অর্থসম্পদ পাচার করেছে, মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে সব সাংবিধানীক প্রতিষ্ঠান, বিষাক্ত করেছে সামরিক-বেসামরিক প্রতিষ্ঠান।
এমতাবস্থায় ভেঙ্গে পরা এই রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংবিধান সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। পরিতাপের বিষয়, সুবিধাবাদী কিছু রাজনৈতিক দল ন্যূনতম সংস্কার করে যেনতেনভাবে দ্রুত ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংবিধান সংস্কার করবে বলে সাধারণ মানুষকে বোঝাচ্ছে। এখন প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্ন আসে-তারা ক্ষমতায় যাওয়ারে পর যে রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কার করবে তার নিশ্চয়তা কী?
তবে ছাত্ররা এর বিপরীতে অবস্থান করছে। তারা সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছে, জলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এর গুরুত্ব এখানেই যে, গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাই হবে এই প্রোক্লেমেশনের মূল কথা। এ রকম বৈপ্লবিক সংস্কার বা নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে অবশ্যই নির্বাচিত সংবিধান সভার মাধ্যমে।
এখানে জাতীয় নির্বাচন, সংবিধান সংস্কার, ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণসহ নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দণগুলো ও ছাত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠছে।
রাজনৈতিক দলগুলো ও বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো এই গণঅভ্যুত্থানকে শুধু রেজিম চেঞ্জ মনে করছে এবং ক্ষমতার হাতবদলে আগ্রহী, যা প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন বাংলাদেশ, যা জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে, তা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ অলিগার্কদের স্বার্থের পরিপন্থি হবে বলেই তারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আর সে জন্যই ৯০-এর মতো ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে হাইজাক করার সব আয়োজন চলছে।
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে রাজনৈতিক দলগুলো চলমান সংবিধানের ভিত্তিতেই দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের পথ খুঁজছেন, তাতে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, এনজিও, আঞ্চলিক পরাশক্তি ও গ্লোবাল পরাশক্তির সঙ্গে আপসে গিয়ে দেশের বিদ্যমান সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামো এবং সিস্টেম বজায় রেখে চলার রাজনীতি শুরু করেছে। আগের সেই দ্রোহভাব এখন তাদের মধ্যে নেই।
এটা বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে সংবিধানের বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে দিয়ে পুরানো ‘সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র’ অব্যাহত রাখার দিকে দেশকে নিয়ে গেলে সংকট সমাধান না হয়ে, তা আরো জটিল হবে।
বস্তুত, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র অথবা ‘সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ’র বিরুদ্ধে একটা গণরায়। ফলে সাংবিধানীক ধারাবাহিকতার আলাপ আসলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তু তৈরির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জোরালো অভ্যুত্থান। কিন্তু এ রকম একটা সৃুযোগ আসার পরও যারা দেশের বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্য কাজ না করে শুধু ক্ষমতার হাতবদলের কথা ভাবছেন, নিঃসন্দেহে তারা গণশক্র। তাদের এধরনের দেউলিয়াপনা ও আপোষকামীতার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসে-তা হলে কী দরকার ছিল জুলাই বিপ্লবের? এই বিপ্লব সফল করার জন্য যারা জীবন দিল ও আহত হলো, তাদের কাছে এই ব্যর্থতার জবাব কী হতে পারে?
অবাক হওয়ার বিষয়, যেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সম্পন্ন হলো, সেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নিয়ে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখনো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি!! বরং নির্লজ্জের মতো পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে চায়! ধারণা করা হচ্ছে, আঞ্চলিক পরাশক্তি ও গ্লোবাল পরাশক্তির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী গণহত্যার বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি ও নির্বাচনের সুযোগ করে দিতে চাচ্ছে, বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো! রাজনৈতিক দলগুলোর এমন সুবিধাবাদী ও আপোষকামী আচরণ পুরো জাতির সাথে চরম বেঈমানী করারই নামান্তর!!
এ কথা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি বলেই বারবার এখানে গণঅভ্যুত্থান করতে হয়েছে জনগণকে। তবে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্র গঠনের সেই সুযোগ এসেছে, তা কাজে না লাগাতে পারলে আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি আরও কঠিন হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকশ সব সময়ই স্তব্ধ করতে চায়, সংস্কারহীন নির্বাচন আয়োজনের দাবির মাধ্যমে ভারত মূলত তার সে বাসনাই খোলাসা করেছে। ‘বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলে দক্ষিণ এশিয়ায় রোলমডেল ও স্বাভাবিক নেতৃত্বে পরিণত হবে’-এটা ভারত কখনো চায় না। ভারত সর্বদাই বাংলাদেশকে তাদের তাবেদার বা পুতুল রাষ্ট্র হিসেবে বানিয়ে রাখতে চায়। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে সেটা হবে ভারতের জন্য হবে দুঃস্বপ্ন। আর সে কারণে গত জানুয়ারির আগে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের বিরোধীতা করেছে ; জুুলাই অভ্যুত্থানের পর তারা রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের বিরোধীতা করেছে একই কারণে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে দিল্লির বাংলাদেশবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার সঙ্গে আমাদের দেশর কিছু বড় বড় রাজনৈতিক দলের অভ্যুত্থান-পরবর্তী অবস্থানের গভীর মিল লক্ষ করা যাচ্ছে!
বস্তুত, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করে ভিন্ন এক জায়গায় প্রতিস্থাপন করা। যেখানে মানবাধিকারের নিশ্চয়তা, বিচার পাওয়ার অধিকার, ভোটাধিকার, নতজানু পররাষ্ট্রনীতির পরিহার, ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন এক রাষ্ট্র গঠন করাসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, জুলাই বিপ্লবের কয়েক মাসের মধ্যেই সেই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিস্থাপিত হতে দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী আকাঙ্ক্ষায়। পরিলক্ষিত হচ্ছে রক্তস্নাত জুলাইয়ের অভিপ্রায় থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসার প্রবণতা!!
এমতাবস্থায় শত বাধা বিপত্তির পরও জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য আমাদেরকে যেভাবেই হউক ৫ আগস্টের ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখতে হবে। নইলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না। বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়নের সময় দেশবাসীর মধ্যে যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল, সেই ঐক্যধরে রাখতে পারলে ভারত এতদিনে বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তন মেনে নিত।
ভারত আবারও বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটাতে চায়। আমাদের দেশে তাদের মদদপুষ্ট পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সুতরাং বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র আন্দোলনকারী ও রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত-নিজেদের মধ্যে মতভেদ থাকলে, তা আলাপ-আলোচনা করে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধান করা। যদি এর ব্যতিক্রম ঘটে, তা হলে আবারও আমাদের দেশে ভারতের আধিপত্যবাদ ফিরে আসবে ; ফিরে আসবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। অতএব, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভাজনের রাজনীতিতে না গিয়ে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর রাজনীতি শুরু করা এখন সময়ের দাবি।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized