শনিবার সকাল ১১:১৬, ৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ. ২১শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সর্বশেষ খবর:
‘আমার স্ত্রী মাকসুদাকে মেরে ফেলেছি, আমাকে থানায় নিয়ে যান’ বন্যার্তদের জন্য জাতীয় সাংবাদিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের আলোচনাসভা ও দোয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া আয়কর আইনজীবী সমিতির অভিষেক ও দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠিত ২৮ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা একাডেমিতে ‘মাতৃভাষা উৎসব’ ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বোর্ড নির্বাচন অনুষ্ঠিত নির্বাচনী পোস্টারে লেমিনেশন ও পলিথিন ব্যবহাররোধে স্মারকলিপি ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর জাতীয় পার্টি: চুন্নু মাতৃভাষা একাডেমিতে কবিতা আড্ডা অনুষ্ঠিত হোমিওপ্যাথিক হেলথ এন্ড মেডিকেল সোসাইটি ব্রাহ্মণবা‌ড়িয়া সম্মেলন অনু‌ষ্ঠিত ব্রাহ্মণবা‌ড়িয়ার বিখ্যাত বাইশমৌজা বাজার ও গরুর হাট ব্রাহ্মণবা‌ড়িয়ায় তরুণ আলেমদের ২য় মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত তরুণ আলেমদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

গ্রাম আমা‌দের বিষ্ণুপুর: যেন এক স্বর্গের টুকরো!

১১৭৭ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি
তিতাস পুর্বাঞ্চলে আমাদের প্রিয় গ্রাম বিষ্ণুপুর। বিষ্ণু নামক ত্রিপুরার রাজপ্রতিনিধির নাম অনুসারে বিষ্ণুপুর নামের উৎপত্তি। তার তত্ত্বাবধানেই এ এলাকায় সু-উচ্চ বাতিঘর নির্মিত হয়েছিল। বিষ্ণুপুর শ‌ব্দের অ‌ভিধানীক অর্থ বিষ্ণু‌দেবতার গ্রাম। য‌দিও সনাতন ধ‌র্মের অনুসারীরা এখা‌নে কখ‌নো স্থায়ীভা‌বে বস‌তি স্থাপন ক‌রে‌নি । আমাদের পূর্ব পূরুষেরা আনুমানিক ৩০০ বৎসর পূর্বে কু‌মিল্লা জেলার বুরিচং থানার “কান্দুঘর” গ্রাম থেকে এখানে আসেন এবং ছোট ছোট টিলা বেষ্টিত বন -জংগল পরিষ্কার করে বসতি শুরু করেন। ধারণা করা হয়, প্রায় ৩০০ বছর পূর্বের পূর্বপুরুষেরা সুদূর আফগানিস্তানের “খাওয়ারজিম” শহর থেকে ভাগ্যঅন্বষণে কান্দুঘর গ্রামে এসেছিলেন । সম্ভবত তারা বিখ্যাত সুফি সাধক জালাল উদ্দিন রুমির বংশধর ছিলেন । গ্রামের অন্যরাও এসেছেন দেশে বিভিন্ন জায়গা থেকে । তখন বিষ্ণুপুরের জঙ্গলে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার বাস করতো। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ত্রিপুরার পাহাড়ী এলাকা থেকে বন্য শুকররা দল বেঁধে এসে ফসলি জমি নষ্ট করতো।
এ ছাড়াও নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে প্রজনন মৌসুমে বাঘ তার সঙ্গিনীকে কাছে না পেলে উম্মাদ হয়ে ফসলি জমি নষ্ট করে দিতো। এই বৈরী পরিবেশ থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য কৃষকেরা উক্ত সময়ে অস্থায়ীভাবে উচুঁ টং ঘর তৈরী করে দু’নালা বন্দুক দিয়ে দিবা-রাত্রি ফসল পাহাড়া দিতো এবং সারা রাত আগুন জ্বালিয়ে রাখতো । তখনকার লোকেরা ছিল কঠোর পরিশ্রমী ও সাহসী। তারা ভোরে বাদ ফজর পান্তা ভাত খেয়ে বাড়ীর কামলাদেরকে সঙ্গে নিয়ে কাজে চলে যেতো আর কাজ থেকে ফিরতো বাদ আছর। মাঝে মধ্যে কাজের চাপে দুপুরের খাবার খাওয়ারও সময় পেতো না। তখন সবার মধ্যে লোভ লালসা কম ছিল; সহজ-সরল জীবন যাপন করতো । একজ‌নের সা‌থে অন‌্যজ‌নের আ‌ত্মিক সম্পর্ক ছিল ; একজ‌নের বিপদ‌ে অন‌্যজন প‌া‌শে থাকত, সাহস যোগাত ম‌নে।

এক সময় এ এলাকায় গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, খালভরা মাছ, ক্ষেতভরা সোনার ফসল, বাগানভরা ফলমুল তরি-তরকারি ছিল। এটা কোনো রূপকথার গল্প নয়, বাস্তব সত‌্য। বিষ্ণুপুর গ্রামের পূর্ব দিকে ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড় ও টিলা রয়েছে। এসবকে আঞ্চলিক ভাষায় মুড়া বলা হয়। ছোট ছোট মুড়ার উপর সারিবদ্ধভাবে লাগানো আছে কাঁঠাল, পেয়ারা ও লিচু গাছ। তবে কাঁঠাল গাছের পরিমাণই বেশি। আর পাহাড়ের ঢালুতে আছে বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গাছ ও লতা পাতায় পূর্ণ ছোট জঙ্গল বা খাঁবার। পাহাড়ের পাদদেশের সমতল ভুমিকে আঞ্চলিক ভাষায় লুঙ্গা বলা হয়। প্রাকৃতিক ভাবে লুঙ্গার মাটির নিচে সবসময় অফুরন্ত পানি জমা থাকে। প্রায় ৫০ফুটের মতো খনন করলে পানির স্তর পাওয়া যায়। তখন সেই খননের স্থানে পাইপ জাতীয় কিছু স্থাপন করে দিলে উক্ত পাইপ দিয়ে কোন চাপ ছাড়াই বিরামহীনভা‌বে পানি আসতে থাকে। আঞ্চলিক ভাষায় এ পদ্ধতিকে গাই বলা হয়। ত‌বে বর্তমা‌নে  গাই পদ্ধ‌তির প্রচলন অ‌নেকটাই ক‌মে গে‌ছে। এখন কৃষকরা গাই‌য়ের প‌রিব‌র্তে সেলু‌মে‌শিন ব‌্যবহার ক‌রেন।  বস্তুত, জ‌মি‌তে ফসল ফলা‌নোর জন‌্য এখা‌নে পা‌নির তেমন সমস‌্যা হ‌য় না। তাই এখানকার কৃষকগণ লুঙ্গার জমিতে নিয়মিত আউশ, আমন, ইরি ও বোরু ধানের চাষ করে থাকেন। অসংখ্য ছোট ছোট টিলায় গেড়া ছায়া ডাকা পাখি ডাকা আঁকাবাকাঁ কাচাঁ মেঠু পথ ।

চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংগ্য গাছগাছালি; গাছ গাছালিতে সব সময় থাকে নানান জাতের পাখির কলরব। মুড়াগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- আলীয়া মুড়া, ভালুকের মুড়া, ধুপা খোলার মুড়া, খাঁ বাড়ির মুড়া, বড় মুড়া ইত্যাদি। এই নৈসর্গিক দৃশ্য যে কেউ দেখলে আনন্দে শিউরে উঠবে! তখন কবি নজরুলের “একি অপরুপ নীলিমা তোমায় হেরিনো পল্লী জননী” বিখ্যাত গানটির কথা অজান্তেই মনে পড়ে যাবে ! টিলাগুলোর উপরে উঠে চারদিকে তাকালে দেখা যায় সবুজ আর সবুজ। বর্ষাকালে অতি সহজে মেঘমালাকে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। পাশেই পূর্ব‌দি‌কে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ওই‌দি‌কে তাকালে অসংখ্য টিলা আর পাহাড় দেখা যায়; চাতুর্দি‌কে সবুজ আর সবুজ । এ যেন ভূ-স্বর্গ !

মুড়াগু‌লোর প‌শ্চিম পা‌শেই চট্রগ্রাম-‌সি‌লেট রেলপথ।গ্রামের উত্তর -পূর্ব দিকে উঁচু নিচু লাল কাচা মাটির রাস্তার উভয় পাশে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি কাঁঠাল গাছ। আর সমভুমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাল মাটির অসংখ্য ঘর। ত‌বে বর্তমা‌নে কিছু পাকাঘরও তৈ‌রি হ‌চ্ছে। আর এসব ঘরের আঙ্গিনা ও তৎসংলগ্ন জমিতে লাগানো থাকে বিভিন্ন জাতের শাক-সবজি, ইক্ষু ও চিনা বাদামের গাছ। দক্ষিণ পশ্চিম দিকে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত নিচু জমি। যাকে আঞ্চলিক ভাষায় লামা বলা হয়। বর্ষাকালে লামার জমিগুলো পানিতে থৈ থৈ করে।

লামার জ‌মিগু‌লো‌ তখন বিশালাকার জলাশ‌য়ে প‌রিণত হয় ; চারি দিকে সাদা শাপলা ও লাল পদ্ম ফুল ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকে, যা স্বচক্ষে দেখলে মন শিহরীত হয়ে উঠে ! তখন মনে হবে শুধু মাত্র আমাদের বিষ্ণুপুর গ্রামের লামার জমিতেই আকাশ থেকে সরাসরি স্বর্গ নেমে এসেছে। তখন গ্রামের মানুষের চলাচলের প্রধান বাহন হয় নৌকা। এ সময় ব্যবসায়ীরাও অল্প খরচে মাল পত্র বহন করতে পারে। বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানও বৎসরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশী অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বরযাত্রীদের নৌকায় প্রায়ই আব্দুল আলীমের “নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইল্লা বন্ধুরে যাও কইয়া” বিখ্যাত গানটি শোনা যায়। এ সময় নাইয়র-নায়রিদের আমাদের এলাকায় আসার ধুম পড়ে যায়। বর্ষা ঋতুর সময় আমাদের দেশে উজান থেকে বিপুল পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যার সৃষ্টি করে। এ বন্যায় প্রায় প্রতি বছরই প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয়ে থাকে। আল্লাহর রহমতে বিগত ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের গ্রামে এ ধরনের কৃতিনাশা বন্যা কখনো হয় নি।

শীতকালে লামার জমিগুলো থাকে রিক্ত। আমন ধান আর রবিশস্যের প্রায় সব ফসলই কৃষক ঘরে তুলে ফেলে। তাই মাঠের পর মাঠ ফাঁকা পড়ে থাকে। তখন আকাশ থাকে পরিস্কার। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য খুব চমৎকার উপভোগ করা যায়। এই সময় আখ মাড়াই শুরু হয়। আর আ‌খের সু‌মিষ্ট রস আগু‌নে জাল দি‌য়ে বি‌শেষ প্রক্রিয়ায় তরল গুড় তৈ‌রি করা হয়। আঞ্চ‌লিক ভাষায় এটা‌কে `ল‌ালি` বলা হয়। বি‌ভিন্ন ধরনের মিঠা-পা‌য়েশ তৈরির সময় এই লা‌লি ব‌্যবহার করা হয়। আশপাশ এলাকায় এই লালির প্রচুর চা‌হিদা র‌য়ে‌ছে।

আমা‌দের এলকার জলবায়ু বেশ আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর। প্রাকৃতিক ভাবে সৌন্দর্যমন্ডিত এ গ্রাম নগরবাসীদের চোখ জুড়িয়ে দেয়। তিতাস পূর্বাঞ্চল উজান এলাকা হওয়ার পরও এখানে রয়েছে বেশকটি নদী, খাল ও বিল। যেমন- ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে “কালাছড়া” নামক নদীটি বিষ্ণুপুরের পূর্ব ও উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে তিতাসে পতিত হয়েছে। আর ত্রিপুরা এলাকার পাহাড়ী এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে “সালদা” নামক খালটি বিষ্ণু পুরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে তিতাস নদীতে গিয়ে ক্ষীণধারায় মিশেছে। শীতকালে এ খালটি মৃতপ্রায় থাকে কিন্তু বর্ষাকালে বেশ স্ফীত হয়ে উঠে। শীতের শুরুতে সুদুর সাইবেরিয়া ও মোঙ্গলীয়া থেকে বিভিন্ন প্রজাতের অতিথি পাখির আগমন ঘটে এ জলাশয়গুলোতে। ঝাঁক ঝাঁক পাখির কলতানে এ এলাকা তখন মুখরিত হয়ে উঠে; যা খুবই মন-মুগদ্ধকর!

উজান এলাকা হওয়ার কারণে এখা‌নে তেমন পুকুর নেই। কূপ ও নলকূপ মাধ‌্যমে এলাকার লো‌কেরা পা‌নির চা‌হিদা পূরণ ক‌রেন। আরে জলাশয় কম হওয়ার কার‌ণে এই এলাকার কৃষকরা মাছ চাষে তেমন পটু নয়; তারা অত্রএলাকার কাজলাবিল, শাপলাবিল, শিয়ালেরবিল ও ধুপাউরিরবিল থেকে মাছ সংগ্রহ করে থাকেন । চৈত্র-বৈশাখ মাসে উক্ত বিলগুলোর উঁচু জায়গায় অস্থায়ী ঘর তৈরী করে কৃষকরা সপরিবারে ওই খানে মাস খানেক অবস্থান করে বোরু ধান সংগ্রহ করেন; তখন নতুন ধানের মউ মউ গন্ধে চারদিক ভরপুর হয়ে যায় । বিলের ধান কাঁটার কাজ শেষ হওয়ার পর পরই লামার জমি গুলো থেকে বর্ষার পানি সরতে শুরু করে । অতঃপর উক্ত জমিতে ইরি ধানের চারাগাছ লাগানো হয় । আশিন-কার্তিক মাসে ধান গাছ গুলো গাঢ় সবুজ রং ধারণ করে এবং সারিবদ্ধভাবে বাতাসের তালে তালে ঢেউ খেলে খেলে দুলতে থাকে ! এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে পথিক গুন গুন করে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গান, “আজি ধানের ক্ষেতে রুদ্র-ছায়ায় লুকোচুরির খেলারে ভাই লুকোচুরির খেলা” মনের আনন্দে গেয়ে থাকেন ।

আমাদের এলাকায় বেশ কিছু লৌকিক খেলাধুলা আজও বেশ জনপ্রিয়। যেমন- কাবাডী, দাড়িয়াবান্দা, ডাঙ্গুলী, কানামাছি, মার্বেল, লাই, কুমির খেলা ইত্যাদি। শৈশব কালে শীত অথবা গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাড়িতে বেড়া‌তে আসতাম আর তখন সহপাঠিদের সাথে অতি আনন্দের সাথে উক্ত খেলাগুলোতে আমরা অংশ নিতাম। এছাড়াও পিচলি দিয়ে পিচকারি মারা, গুলতি দিয়ে পাখি শিকার, আম গাছের ডাল দিয়ে লাঠিম ও বাঁশের কাঠি দিয়ে তিতুমিরের ধনুক বানানো, লিচু বাগানে ছক্কা খেলা, পেয়ারা বাগানে লুকুচুরি খেলা, স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলা, মসজিদের পুকুরে সকাল-সন্ধ্যা গোসল করা, সালদা খালে বরশি দিয়ে মাছ ধরা, ভোরে ঘুম থেকে উঠে আম কুড়ানো, শীতের সন্ধ্যায় বিনা পয়সায় আখ মাড়ানোর ব্যাক্তির নিকট থেকে আখের রস পান করা, আলীয়া মুড়ায় শাহজালাল-গৌরগোবিন্দের যুদ্ধ খেলা, বাড়ির উঠানে গরু দিয়ে ধান মাড়ানো, সময় অসময়ে আশ-পাশ গ্রামে হারিয়ে যাওয়া, সন্ধ্যায় ছোট চাচা জালাল আহম্মদ খান ও ফুফু সালেহা খাতুনের আমাকে খুঁজে ফেরা আরো কত কি ! এসব স্মৃতি খুবই আনন্দময়, যা কখনো ভূলা যায় না।

আমাদের গ্রামের লোকেরা সহজ, সরল ও ধর্মভীরু। হবিগঞ্জের সুফিসাধক সৈয়দ শাহ ইসমাঈল ও খরমপুরের পীর শাহ সৈয়দ আহম্মদ গেছুদরাজের পরম ভক্ত এরা। কোন মনোবাসনা সিদ্ধির জন্য তারা উক্ত সাধকদের মাযার শরীফে গিয়ে মানত আদায় করে থাকেন। সুদূর অতীত কাল থেকে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো তারা মহাধুমধামে পালন করে আসছেন ।

এখানকার কৃষকগণ নানান ধরনের সবজি, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু চাষে খুবই পারদর্শী। শীত গ্রীষ্ম বলে কোনো কথা নেই। বছর জুড়েই বিষ্ণুপুর ও আশপাশের গ্রামে বিভিন্ন জাতের সবজি , কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, মাল্টা ও আখের চাষ হয়। ফরমালিনহীন এসব তরতাজা সবজি ও ফল ফলাদি দুর দুরান্তের বিভিন্ন হাটে বিক্রি হয়। আমাদের গ্রামের দক্ষিণ দিকে মিরাশানী ও সিঙ্গারবিল গ্রাম। পশ্চিম দিকে শ্রীপুর ও খিরাতলা। উত্তর দিকে রয়েছে ছতোরপুর ও দুলালপুর এবং পূর্ব দিকে কাশিমপুর ও মহেষপুর। বিষ্ণুপুর গ্রামটি আশপাশের কেন্দ্র বিন্দু। একে এলাকার নাভি বলা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এ অঞ্চল ভ্রমণকারীদের জন্য একটি লোভনীয় স্থান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে সড়ক, রেল ও নৌপথে অতি সহজে ও অল্প খরচে এখা‌নে আসা যায়। আমার শৈশব কৈশোরের অনেক দুরন্তপনার স্মৃতি র‌য়ে‌ছে এ গ্রামকে কেন্দ্র করে। একবার বর্ষাকালে জ্যোৎসনারাতে ছোট কাকা জালাল আহ‌মেদ খান আমাদের কয়েকজন সহপাঠীকে লামার জমির পাড়ে নিয়ে গেলেন। নীল আকাশে চাঁদের মধুর আলো। মেঘ নেই তাই আকাশ ভরা তারার মেলা। পূর্নিমার চাঁদ যখন বিলের পানিতে পড়লো তখন ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলের সমস্ত শাপলা, পদ্ম ও কচুরিপানার ফুলগুলো তালে তালে দুলতে লাগলো। এ সময় আমাদের এক সহপাঠি গুণগুণ করে গাইতে লাগলেন মানবেন্দ্র মুখার্জীর সেই বিখ্যাত গান “ময়ুরকন্ঠী রাতেরও নীলে, আকাশে তারাদের ঐ মিছিলে।”

ছোট কাকা লাল নীল পরীর গল্প শুরু করলেন। আমরা তন্ময় হয়ে এমন ভাবে তার গল্প শুনছিলাম, মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই আকাশ থেকে লাল-নীল পরীরা নেমে এসে ময়ূরপঙ্খী নাও এ করে আমাদেরকে পরীর দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় পাশের জঙ্গল থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক শুরু হল। শিয়ালের অগণিত ডাকে আমাদের গল্পের তন্ময়ভাব কাটল। আমরা সবাই বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম।

আমাদের গ্রামের আরেকটি রোমান্টিক স্মৃতি আমার মনে প্রায় সময়ই দোলা দেয়। আমার সঙ্গে সুনয়না-লাবণ্যময়ী শেখ সালমা আক্তার হেলেনের বিয়ে হয় ১৯৯৫ সালের জুন মাসের শেষের দিকে। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়ানোর উদ্দেশে সস্ত্রীক ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ট্রেনে করে সকালে আখাউড়া পৌঁছি। তখন ছিল গ্রীষ্মকাল- আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, লেবু, লিচু প্রভৃতি রসালো ফলের সময়। আমরা আখাউড়া পৌঁছে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য একটা রিকশা ঠিক করে নেই। রিকশাচালক আমার অতি ঘনিষ্ঠ ও এক সময়কার সহপাঠী বেলাল হোসেন। রিকশায় চড়ে আমরা বিষ্ণুপুরের দিকে যেতে থাকি। একে একে খড়মপুর, আজমপুর, সিঙ্গারবিল পার হয়ে মিরাশানী গ্রামের দিগন্ত বিস্তৃত লামার জমির নিকট এসে পৌঁছি। সূর্য তখন মাথার উপরে। বাতাসে আসছে আগুনের ফুলকি; লামার জমির পানি শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে । প্রচণ্ড খরতাপে আমরা খুবই ক্লান্তবোধ করি। এ অবস্থায় বেলালের মাধ্যমে মিরাশানী বাজার থেকে বিস্কুট, চিপস, কোমল পানীয় আনাই। অতঃপর লামার সন্নিকটে বিশাল কাঁঠাল গাছের ছায়ার নিচে বসে খাই। ক্লান্তিভাব দুর হয়। তারপর ব্যাগে থাকা ক্যামেরা বের করে বেলালের মাধ্যমে বেশকিছু জায়গায় আমাদের ক’টি যুগলবন্দী ছবি তুলি। তারপর রিকশায় উঠে আবার বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করি। যখন কাশিমপুর গ্রামের পথে রিকশা‌টি থামলে তখন আমরা অবাক হয়ে যাই। কোথাও কোনো মানুষ নেই। চারিদিকে নিস্তব্ধ নীরবতা। রাস্তার উভয় পাশে সারি সারি কাঁঠাল গাছ। প্রতিটি গাছই কাঁঠালে পরিপূর্ণ। মনে হচ্ছে ভুলে আমরা কোনো বিশাল কাঁঠাল বাগানের মধ্যে চলে এসেছি। গাছে পাখিদের কিচির মিচির শব্দ। কোথাও বা দুই/তিন জন লোক গাছের ছায়ায় অলস শুয়ে আছে।

প্রাকৃতিক কারণে প্রচন্ড রোদে ঘর থেকে কেউ বের হচ্ছে না। মাঝে মাধ্যে কয়েকজন কৃষককে কাঁঠালভর্তি ভ্যানগাড়ি বাজারের দিকে নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। শূন্য মেঠোপথ। গাছের ছায়ায় ছায়ায় আমাদের রিকশা যাচ্ছিল। চতুস্পার্শ্ব শ‌্যমলময়। রিকশার বেলের টুংটাং আওয়াজ অনেক বেশি শব্দ করছিল এ সুনসান নিরবতায়। এ সময় আমি ও হেলেন দ্বৈত কন্ঠে গুণগুণ করে গেয়ে চললাম রবীন্দ্রনাথের “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ” মেঠুসু‌রের সেই বিখ্যাত গানটি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বাড়ির গোপাটে এসে রিকশা থেকে নামি। গ্রীষ্মের নিঝুম দুপুরের এ রোমঞ্চকর দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। যা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।

আল্লাহর রহমতে ঘুর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যাসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে এখানকার ছোট ছোট পাহাড় ও অসংখ্য গাছ গাছালি আমাদের এলাকাকে রক্ষা করে চলেছে। বাবার চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে আমরা ঘুরেছি। কিন্তু নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা আমাদের এ এলাকার মতো এমন জায়গা আর কোথাও দেখিনি। এই পৈ‌ত্রিকভূ‌মি‌কে আমার কা‌ছে জান্না‌তের এক টুক‌রো ম‌নে হয়। এখা‌নে  আস‌লে আমি মান‌সিক প্রশান্তি পাই।

বর্তমানে আমি দুই সন্তানের জনক। শহরে বসবাস করি। ম‌নেপ্রা‌ণে আমি ও আমার পরিবারবর্গ আমা‌দের এলাকার মাটি, মানুষ ও নৈসর্গিক সৌর্ন্দযকে ভীষণ ভালবাসি। সুযোগ পেলেই আমরা সেখানে বেড়াতে যাই।

খায়রুল আকরাম খান

ব‌্যু‌রো চীফ

deshdorshon.com

Some text

ক্যাটাগরি: Uncategorized

Leave a Reply

Mostbet Com’da Oynamak Mı Istiyorsunuz?…

ভার‌তের আধিপত্যবাদ ও বাংলা‌দেশ

Casinos Online Confiables Por Dinero…

আগে সংস্কার প‌রে নির্বাচন

Sådan Vælger Du Det Bedste…

1win Brasil Apostas E Cassino…

Best Online Casinos With Regard…