
আধিপত্যবাদ, আগ্রাসনবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। মূলত এসব শব্দের মাধ্যমে সাধারণত এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করা বোঝায়। এটা নিজের কর্তৃত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব যেকোনো উপায়ে বজায় রাখার একটি কৌশল। সহজ ভাষায় বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে মোড়ালিপনা করা বা খবরদারি করা।
বিশ্বের ক্ষমতাধর ও ধনী রাষ্ট্রগুলো সব সময় এমন ইস্যু খোঁজতে থাকে, যার মাধ্যমে কোনো জাতিকে নিজেদের স্বার্থে নিঃশেষ করা যায়, পরাভূত করা যায়। যার মধ্যে রাজনৈতিক, আর্দশিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ অন্যতম।
উল্লেখ্য, ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। কিন্তু তার আগ্রাসী, আধিপত্য ও প্রভূত্বমূলক মনোভাবের জন্য ধীরে ধীরে বাংলাদেশের শক্র রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই সম্পর্কের আরো ভয়াবহ অবনতি ঘটে। ভারত কিছুতেই আমাদের এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারছে না। বরং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে।
মূলত, আধিপত্যবাদী ও অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের কারণে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের সাথে কোনো প্রতিবেশীরই সম্পর্ক কখনো ভালো ছিল না ; এখনো নয়।
বস্তুত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় মোড়লিপনা ও আধিপত্যবাদের সূচনা ঘটে ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে একটি সাত দফা গোপন চুক্তির মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সাথে কোনো ধরনের পরামর্শ না করে মুজিবনগর সরকার এই চুক্তি করে। এই চুক্তিতে ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতের অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার মূল বীজ রোপিত হয়। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন মুজিবনগর সরকারের পক্ষে অস্থায়ীরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ভারত সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দীরা গান্ধী।
চুক্তি গুলো হলো-(১) ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হবে। তবে কোনো সামরিক বাহিনী গঠন করা যাবে না। গুরুত্বের দিক হতে এবং অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় এই বাহিনী বাংলাদেশের মূল বাহিনী হতে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ হবে। (২) ভারত থেকে সমরোপকরণ অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করতে হবে এবং ভারতীয় সমরবিদদের পরামর্শানুযায়ী তা করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ না নেওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যূত করে তাদের স্থলে ভারতীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হবে। (৩) ভারতীয় পরামর্শেই বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে। (৪) বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভারতীয় পরিকল্পনার সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। (৫) বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ হতে হবে। (৬) ভারত-বাংলাদেশের চুক্তিগুলো ভারতীয় সম্মতি ব্যতীত বাতিল করা যাবে না। (৭) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বের দায়িত্ব শুধু ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধানের হাতে ন্যস্ত থাকবে। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত যেকোনো সময় যেকোনো সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং বাধাদানকারী শক্তিকে চুরমার করে অগ্রসর হতে পারবে।
এই চুক্তির পর পরই ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। শুরু হয় পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমন। যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমনের ফলে পাক-বাহিনী দিশেহারা হয়ে পরে। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর বিকাল দিকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদসহ নিঃশর্তে পাক-বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান লেঃ জেঃ আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী যৌথ-বাহিনীর প্রধান লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরোরার নিকট আত্মসমপর্ণ করেন। প্রায় ৩০ লক্ষ লোকের রক্ত ও ৪ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, দালিলিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভারত তাদের একক কৃতিত্ব ও নিপুণতা অটুট রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানীকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সেদিন আসতে দেয়নি, তাকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল ! আরো অবাক হওয়ার বিষয় হলো, এই আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই স্বাধীন বাংলাদেশের পরিচালনার দায়িত্ব লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরোরার নিকট চলে যায়। এমনকি আত্মসমর্পণকারী সকল পাকিস্তান সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিতকরনের দায়িত্বও চলে যায় ভারতীয় বাহিনীর হাতে! আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী এটার ন্যস্ত হতো বিজয়বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। এটা হলে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ-অপরাধী হিসেবে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিচার করতে পারতো এবং তাদের জমাকৃত অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ সামগ্রী দখলে নিতে পারতো।
কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজেদের প্রভূত্ব ও দাম্ভিকতা বজায় রাখার স্বার্থে ভারতীয় বাহিনী এমন জঘন্য কাজটি করলো, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের আঘাত স্বরূপ। আরো অপমানজনক বিষয় হলো, দালিলিকভাবে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভারত সরকার সব সময় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করে আসছে। আজও ভারত সরকার ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি!! এটা অবশ্য ভারতের আগ্রাসী মনোভাবেরই প্রকৃত চিত্র। আরো দুঃখজনত বিষয় হলো, এটা নিয়ে কোনো সরকারই আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকারের নিকট কোনো প্রতিবাদ জানায়নি! অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইস্যু নিয়ে অনেক সরকারই ক্ষমতায় এসেছে! এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কারো সহানুভূতির দান নয়, এটা নগদ রক্তে কেনা।
প্রসঙ্গত, এটা আজ স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার প্রবল আকাংখা ও জাতীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জন্যই ভারত সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে অস্ত্র ধরেছিল। মূলত বাংলাদেশকে চির অনুগত রাষ্ট্র বানানোর জন্যই ভারত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল, এখানে মানবিক কোনো বিষয় ছিল না। (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized