প্রত্যেক মা-বাবার জীবনের সকল স্বপ্নই আবর্তিত হয় তাদের প্রিয় সন্তানকে ঘিরে। পিতা-মাতার অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় তাদের সন্তানের মাধ্যমেই। তাই সন্তানের অন্যায্য দাবি মেটাতে তারা নিজেদের সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে প্রিয় সন্তানের মুখে হাসি ফোঁটাতে চান। সন্তানের বায়না মেটাতে গিয়ে অনেক পিতা-মাতা তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছে মোটারসাইকেলের চাবি!! অনিভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণহীন হাতে সেই চাবিই তার মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে উঠছে!!
আনাড়ী এসব বাইক চালকদের যন্ত্রনায় সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সুযোগ নেই। সকাল কিংবা রাত ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় পেছন থেকে বিকট শব্দে হর্ণ বাজিয়ে সাইড চাচ্ছেন অভিজ্ঞতাহীন দুই চাকার চালকরা। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনাসহ নানা অঘটন ঘটছে। ফুটপাতের নিরাপত্তা আইন ও ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো নিয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অপ্রাপ্তবয়স্ক বাইক চালকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।
বস্তুত, মোইরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত ও সহজলভ্য হওয়া ও যানজটের কারণে মানুষ মোটসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং পাশাপশি দুর্ঘটনাও বাড়ছে। অনভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণহীন কিশোর বয়সী ছেলেরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাইক চালিয়ে নিজে গুরুতরভাবে আহত হচ্ছে এবং পাশাপাশি নিরীহ পথচারীও মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন। এধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রত্যক্ষ শিকার আমি স্বয়ং।
উল্লেখ্য, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য আমি প্রায় ১৫ বছর যাবৎ প্রভাতে প্রতিদিন প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটাহাঁটি করি। প্রতিদিনের মতো আমি এমাসের ৬ তারিখে সকাল ৬.৩০ মিনিটের দিকে আমাদের প্রিয় শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ মৌলভীপাড়ার রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ম মেনে বামদিক দিয়ে পুরানো কাচাড়িপারের উদ্দ্যেশে অতি সর্তকতার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এমন সময় অতর্কিতভাবে পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল সজোরে আমাকে আঘাত করে-কিছু বুঝার আগেই মাটিতে ছিটকে পড়ি। লোকজন জমায়েত হওয়ার আগেই আরোহীরা তরিঘরি করে তাদের বাইক নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। উক্ত মোটরসাইকেলের আরোহী ছিল কিশোর বয়সী তিন জন ছেলে। আমি আহত অবস্থায় মাটিতে পারে থাকি।
এমতাবস্থায় কয়েকজন পথচারী আমাকে সদর হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসার পর বহির্বিভাগে অর্থোপেটিস ডাক্তারের নিকট রেফার্ড করেন। তারপর আমি অর্থোপেটিস ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হই। চিকিৎসক আমাকে পর্যবেক্ষন করে দশ দিনের পূর্ণ বিশ্রাম নিতে ও কিছু ঔষধ নিয়মিতভাবে খেতে বললেন। পাশাপাশি তিনি একথাও বললেন, যদি অবস্থার উন্নতি না হয়,তাহলে অপারেশনের দিকে যেতে হবে।
বিদ্যমান সময়ে আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে দুশ্চিন্তা ও উৎকন্ঠার মধ্যে আছি। কোমড় ও হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করছি। এতে আমার প্রত্যহিক কাজের ব্যঘাত হচ্ছে। জানিনা আমার ভাগ্যে কি আছে? আমার মতো প্রতিদিন অসংখ্য পথচারী ও পরিবহন যাত্রী এধরনের অনাড়ী বাইক চালকদের দ্বারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
বর্তমানে উদ্বেগজনক হারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন তরুণেরা মোটনসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। পাশাপাশি পথচারীরাও মারত্মকভাবে আহত হচ্ছেন। টিনেজারের স্বাভাবানুযায়ী তরুণেরা নিজেদের বীরত্ব প্রদর্শন করতে গিয়ে অকালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশেরই বয়স ২১ এর নীচে অর্থাৎ কিশোর-তরুণ। সেফটি রোড ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে ৪৬৪৮ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪৬২২ জনের, যা যাত্রীবাহী গাড়ি আরোহীদের দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি!!
মূলত, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পেছনে কতগুলো কারণ রয়েছে। তা হলো–অদক্ষ বা অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকা, বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিং, ট্রাফিক সিঙ্গনাল না মানা, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলা, হেলমেট ব্যবহার না করা, অসর্তক অবস্থায় গাড়ি চালানো ইত্যাদি।
বস্তুত, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে ব্যক্তি সচেতনতাই মুখ্য। মনে রাখতে হবে, বাইক বেপরোয়া গতিতে চালানোর ফলে চালক শুধু নিজেকেই ঝুঁকিতে ফেলছেন তা নয়, বরং পথচারীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এমনকি পথচারী ও পরিবহন যাত্রীদের অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গুত্বও বরণ করছেন।
‘হিরোইজমের চেয়ে জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে’–জীবন থাকলে মোটরসাইকেল ছাড়াও অনেক জায়গায় তরুণদের বীরত্ব প্রদর্শনের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তাই বাইক চালানোর সময় সর্তক থাকতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনকেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
যেমন-ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে; একই সঙ্গে প্রতিটি দুই চাকার বাহন যেন নিবন্ধত হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে; লাইসেন্সবিহীন চালকদের আইনের আওতায় আনতে হবে; উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে; ১৮ বছরের নীচে কেউ যাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স না পায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে; ১৮ বছরের নীচে কেউ বাইক চালালে তার অভিভাবকে জরিমানার আওতায় আনতে হবে; পারিবারিক সচেনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রশাসনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহিতা আনতে হবে। আশা করা যাচ্ছে, প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে বাইক জনিত দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।
এই অবস্থার প্রেক্ষিতে জনগণ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে একজন ভুক্তভোগী হিসেবে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা আপনাদের সন্তানের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবেন, তার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করবেন, দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সম্পর্কে সমক্য ধারণা দিবেন, ট্রাফিক আইনসহ রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় আইন সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিবনে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর উপযুক্ত ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে আপনার স্নেহের সন্তানের হাতে মোটরসাইকেলের চাবি তুলে দিবেন; এর আগে নয়। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে , তাহলে বাইকের চাবিই হবে তার মৃত্যুর চাবি!!
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : dehdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized
