এখানে অতিসংক্ষেপে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-(১) গণতন্ত্র : জনগণের শাসন, যেখানে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় অংশ নেয়। (২) সমাজতন্ত্র : একটি শোষনমুক্ত ও ন্যায়ানুগ সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শ, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করতে চায়। (৩) ধর্মনিরপেক্ষতা : সকল ধর্মের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেখানে রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। (৪) জাতীয়তাবাদ : বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক।
বাংলাদেশের নতুন এই সংবিধান প্রণয়নের পর পরই রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির বিরুদ্ধে সর্বমহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, কিন্তু তৎকালীন শেখ মুজিব সরকার তাতে তেমন কোনো কর্ণপাত করেননি।
বস্তুত, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৬ দফার ভিত্তিতে। সেই ৬ দফার মধ্যেও আওয়ামী লীগ গৃহীত চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির একটিও উল্লেখ ছিল না। তাছাড়া নির্বচনী ইশতিহারে আওয়ামী লীগ আরো উল্লেখ করেছিল যে, তারা ইসলাম ধর্ম বিরোধী কোনো আইন-কানুনও পাস করবে না। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগই ভারত থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গুটিয়ে নিয়ে এসে ক্ষমতার মসনদে বসার সাথে সাথেই ভারত সরকারের পরামর্শে সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করলো!!
প্রকৃত পক্ষে ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচন ছিল পাকিস্তান কাঠামোর আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করেছিল পাকিস্তানের অধীন ; নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অধীনে নয়। সুতরাং ‘৭২-এর আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংবিধান প্রদান নীতিগত দিক দিয়ে মোটেই বৈধ ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার পূর্বেই জনগণের তরফ থেকে তাদের নতুন ম্যান্ডেট লাভ করা ছিল অত্যাবশ্যকীয়, কিন্তু তারা তা করেনি!! এখানে তারা চরম সংকীর্ণতার পরিচয় দেয় ও মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় রূপকে দলীয় রূপ প্রদানের জন্য বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে থাকে।
যার ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ বহির্ভূত সকল শক্তি হতোদ্যম হেয়ে পড়ে এবং তারা তাদের নবতর আশা-আকাংখার বাস্তবায়ন করার সুযোগ থেকে প্রায় সস্পূর্ণভাবেই বঞ্চিত হয়। যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশে যখন জাতীয় ঐক্যের সর্বাধিক প্রয়োজন ছিল, ঠিক সেই সময়েই আওয়ামী লীগ একলা চলোর নীতি অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে জনমত এবং জনগণের আশা-আকাংখা পদদলিত করে চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ শাসনকালের বিশ্বাসঘাতকতার আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর এখান থেকেই শুরু।
আওয়ামী লীগের এই আচরণ ছিল অনুগত তল্লীবাহকের প্রভূর আদেশ-নির্দেশ পালন করার বাধ্যাবধকতা। কারণ, এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ‘৭২-এর সংবিধান প্রণেতা হচ্ছে স্বয়ং দিল্লীর শাসকচক্র। ‘৭২-এর সংবিধানের উৎস তাই বাংলাদেশের জনগণ নয়, সম্প্রসারণবাদী এবং সাস্প্রদায়িক ভারতীয় শাসক চক্রই হচ্ছে মূল উৎস।
এভাবেই যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের কোটি কোটি বুভূক্ষ মানুষের জন্য অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার পূর্বেই সংবিধানের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এসে মাথায় চেপে বসে। এই চার মূলনীতি আরোপ করার মধ্য দিয়ে দিল্লীর কর্তারা তাদের মূল লক্ষ্যই স্থির করে রাখে।
বাস্তবে এই চার মূলনীতির ছিল বাংলাদেশকে দিল্লীর অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখার অন্যতম প্রয়াস। বিস্ময়কর বিষয় হলো, ভারতীয় সংবিধানও এই চার মূলনীতির ব্যতিক্রম নয়। এই সংবিধানকে ভারতীয় সংবিধানের ফটোকপিও বলা যেতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ সন্নিবেশিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে মূলত ভারতেরই একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে সুক্ষ্ণভাবে চিহিৃত করা হয়েছে, কোনো প্রতিবেশী বা বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে নয়!! (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com