
পূর্ববাংলার সমগ্র জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। এমন একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী শেষের দিকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তবে তাদের এই অংশ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে এমন কিছু চুক্তি ও শর্তের মধ্যে বন্দী রাখা যাতে, আমাদের দেশ সেই বন্দীদশা কখনো মুক্তি পেতে না পারে এবং আজীবন ভারতের তল্পিবাহক হয়ে থাকে। আসলে ‘৭২-এর সংবিধান ছিল সেই সকল দাসত্বমূলক চুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ।
এবারে তাহলে দেখা যাক, ১৯৭২ এর প্রণীত সংবিধানের চারটি মূলনীতি বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে কতখানি সঙ্গতীপূর্ণ। প্রথমেই আসা যাক, গণতন্ত্র তথা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সহাবস্থাসের আলোচনায়। মূলত এ দুটি দর্শন পরস্পর সাংঘর্ষিক। যেমন-(১) গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে প্রধান পার্থক্য তাদের আদর্শের। বিশেষ করে গণতন্ত্র হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি। গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি হলো সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের সমান ভোটাধিকার। এই মতবাদের আধুনিক প্রবক্তা হলেন ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লক। তিনি ১৬৮৯ সালে “টু ট্রিটিজ অন গর্ভমেন্ট” গ্রন্থে গণতন্ত্র সস্পর্কে বিস্তারিত লিখেন। বিপরীতে সমাজতন্ত্র হলো পণ্য ও সেবার উৎপাদন ও বন্টন নিয়ন্ত্রনের একটি পদ্ধতি। সমাজতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি হলো উৎপাদনের উপায়গুলোর উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। এই মতবাদের আধুনিক প্রবক্তা হলেন জার্মান দাশর্নিক ও অর্থনীতিবিদ কাল মার্কস। তিনি ১৮৬৭ সালে “ডাচ ক্যাপিটাল” গ্রন্থে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। উল্লেখ্য, স্কটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের প্রণীত বিখ্যাত “পুঁজিবাদ” তত্ত্বের সমালোচনা করতে গিয়েই কাল মার্কস সমাজতন্ত্রের মতবাদ প্রকাশ করেন। ১৭৭৬ সালে “দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস” গ্রন্থে অ্যাডাম স্মিথ ‘পুঁজিবাদ’ মতবাদ প্রাকাশ করেছিলেন। অবাক হওয়ার বিষয়, পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রের জাতশত্রু হলেও গণতন্ত্রের সাথে রয়েছে চিরমিত্রতা। বস্তুত গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে সরকার গঠন। আর পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক স্বাধীনতাসহ মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। তাই গণতন্ত্রকে পুঁজিবাদের ধারক ও বাহক বলা হয়। বলা যেতে পারে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত।
(২) গণতন্ত্রে , জনগণ সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেয়। একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তা করা হয়। সমাজতন্ত্রে, সরকারের ক্ষমতা সাধারণত একটি কমিউনস্ট পার্টির হাতে থাকে। (৩) গণতন্ত্রে, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং অর্থনীতি সাধারণত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন থাকে। সমাজতন্ত্রে, ব্যক্তি অবাধ স্বাধীনতাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং অর্থনীতি সাধারণত সমগ্র জনগণের মালিকানাধীন থাকে। (৪) গণতন্ত্রে, সরকার পরিবর্তন হয় জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোটে। সমাজতন্ত্রে সরকার পরিবর্তন হয় শুধু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে। (৫) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, বিশেষ করে আমাদের মতো দরিদ্র দেশে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারে না, তাই সংসদে তাদের স্বার্থে কোনো আইন প্রণীত হয় না। এখানে ভোটের সময় ছলে-বলে-কৌশলে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা নির্বাচিত হন এবং তাদের স্বার্থে রাষ্ট্রের সব আইন প্রণীত হয়। সমাজতন্ত্রে, শ্রমিক শ্রেণি সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনা করে এবং রাষ্ট্রের যাবতীয় আইন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবীদের স্বার্থে প্রণীত হয়। এখানে আভিজাত বা ধনীক শ্রেণির কোনো স্থান নেই। (৬) গণতন্ত্র হচ্ছে , পুঁজিবাদের ধারক ও বাহক। পুঁজিবাদে শ্রেণি বৈষম্য ও শ্রেণি শোষন অটুট থাকে। পুঁজিবাদ মুক্তবাজার অর্থনীতিকে সমর্থন করে। সমাজতন্ত্র হচ্ছে ন্যায় ও শোষনহীন সমাজের ধারক ও বাহক। এখানে পুঁজিবাদের মূলোৎপাটন করে ন্যায় ও সমতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। (৭) গণতন্ত্র তথা পুঁজিবাদে, উৎপাদনশীল সস্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকান থাকে। চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে দাম নির্ধারিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা অর্জন করা। বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র করে। ফলে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পরে। কিন্তু সমাজতন্ত্রে উৎপাদনশীল সম্পদ সমজের সকলের বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা হয়। ব্যবসায় মনোপলি বা একচেটিয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখানে সম্পদ ও সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা আনার চেষ্টা করা হয়। সমাজের সকলের কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। (৮) পুঁজিবাদী তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, সমাজে ধনী-গরীবের আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, ফলে সমাজের সর্বত্র অস্থিরতা দেখা দেয় এবং ধনীক শ্রেণি বা শাসক শ্রেণির মধ্যে স্বেচ্ছাচারীতা-অমানবিকতা-ভোগবাদীতা বাড়তে থাকে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, দরিদ্রদের উপকার আসে এমন কর্মসূচির মাধ্যমে সম্পদ বিতরণের করে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করা হয়। এখানে মুনাফার চেয়ে মানবিকতাকে বেশি প্রাধাণ্য দেওয়া হয় এবং যথেচ্ছাচার, ভোগবাদ ও স্বৈরাচ্ছারী মনোভাবকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে সমাজের যাবতীয় অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে কমে আসে।
এসব আলোচনার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, এ দুটি দর্শন ও মতবাদ পরস্পর সাংর্ষিক। একটি অপরটির আজন্ম শত্রু। একটির মুলোৎপাটনের মাধ্যমে অপরটির অভ্যুদয় ঘটে!!
এখন প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্ন আসে-শেখ মুজিবুর রহমান এ ধরণের দুটি বিপরীতমুখী দর্শনকে কেন সংবিধানে সংযোজন করে ছিলেন? বাস্তবে প্রকৃত গণতন্ত্র কায়েম হলে তো অন্য অন্য কোনো মতবাদের কোনো প্রয়োজনই নেই। প্রকৃত গণতন্ত্র তো সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে, সাধারণ জনগণের ক্ষমতায়ণ সহজ করে এবং মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করে। খাঁটি গণতন্ত্রে, জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশ শাসন করে, যা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় এবং সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মূলত ‘৭২-এর সংবিধানে গণতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজতন্ত্র সংযোজন করেছিলেন-সমাজতন্ত্রকে সমুলে ধ্বংস করার জন্য। কথিত আছে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কোটি কোটি ভুখানাঙ্গা মানুষ এবং শিক্ষিত ও বেকার যুবক শ্রেণি ক্রমশ লাঞ্চনা ও বঞ্চনার কশাঘাতে বিদ্রোহী হয়ে উঠে যাতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ধাবিত না হতে পারে, সে জন্যই কেবল প্রতারণার খাতিরে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে গণতন্ত্রের পাশাপাশি ‘সমাজতন্ত্র’কে একটি স্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এটা ছিল নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মানে সমাজতন্ত্র দিয়ে সমাজতন্ত্র ঠেকানোর অপকৌশল মাত্র!!
তবে তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে সমাজতন্ত্র জুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বেশ ফায়দা লুটে নিয়েছে। পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শিল্প, কল-কারখানাগুলোকে বিনা পরিকল্পনায় রাতারাতি রাষ্ট্রীয়করণ করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনসমূহ মূলত বেপরোয়া লুটতরাজ করার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেছিল। রাষ্ট্রীয়করণ করার নামে আওয়ামী লীগ ঘেঁষা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকরণ করা হয়েছিল। শিল্প-কলকারখানাসমূহের লুটতরাজের প্রতিযোগিতা বর্বর চেঙ্গিস-হালাকু খানদেরকেও হার মানিয়েছে। শাসক শ্রেণি কর্তৃক নিজ দেশের এবং জাতির সম্পদ বেপরোয়া লুন্ঠনের দৃশ্য জাতি এই সর্বপ্রথম প্রত্যক্ষ করল। কিন্তু কারোরই প্রতিবাদ করার কোনো ক্ষমতা ও সাহস ছিল না। বিস্ময়কর বিষয় হলো, পুঁজিবাদী ভারত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পুঁজিবাদী কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে সেখানে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে-এমন দুরাশা তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব করলো কি করে? এটা ছিল এক ধরণের অলীক কল্পনা যা, বাস্তবে কখনো সম্ভব নয়!!
সুতরাং কেউ যদি বাংলাদেশের বাস্তবতায় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মতো দুটি বিপরীতমুখী দর্শনকে সংবিধানে সহাবস্থানের মাধ্যম সম্ভবে পরিণত করার প্রয়াস চালায়, তাহলে এটা আশঙ্কা করে বলা যেতে পারে, একই ঘটনার অবতারনা ঘটবে যা, শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে ঘটেছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।
বস্তুত, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্ক ঠাট্টা-তামাশার সম্পর্ক নয়, সে সম্পর্ক হচ্ছে রক্তক্ষয়ী ও আপোসহীন সম্পর্ক-একে অপরের নিঃশেষের মধ্যে টিকে থাকার সম্পর্ক। (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized