
আমাদের দেশে দুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য তা নেই। তবে তা কাগজে-কলমে আছে। এর ফলে প্রতিবারই নতুন করে একই ধরনের বিপর্যয় ও দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে। প্রতিটি সমস্যা ও দুর্ঘটনা চক্রাকারে ঘুড়ছে, স্থায়ী সমাধানের কোনো খোঁজ নেই।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার চকবাজারের নিমতলী এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ৭৮ জনের মৃত্যু হয়। সংকীর্ণ রাস্তার কারণে ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। এই অদক্ষতা ও নগর ব্যবস্থাপনার ব্যথর্তা তখন গণমাধ্যমে টপ নিউজ ছিল। কিন্তু সরকারিভাবে অগ্নিকান্ডের যথার্থ কারণ ও এর সমাধানের কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সরকার শোকবার্তা জানিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করে!
২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর দিবাগত রাত ৩ টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার কসবার মন্দভাগ এলাকায় তুর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনের ২/৩ টি বগি লাইনচ্যুত হয় ও তা তুমড়ে-মুচরে যায়। আর যাত্রী মারা যায় প্রায় ১৫ জন ও গুরুতর আহত হয় শাতাধিক ব্যক্তি। ধারণা করা হয়, স্টেশনমাস্টার, গাড়ীর ড্রাইবার ও গার্ডের গাফিলতির কারণে এমন ভয়াবহ অপ্রত্যাশিত অশুভ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটির একটি সরকারি তদন্ত হয়েছিল, কিন্তু তা কখনো আলোরমুখ দেখেনি!
২০২১ সালের ৩০ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার ‘লইসকার বিলে’ বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে শেখ হাসিনা সড়কের পাশের খালে একটি বালুবোঝাই ট্রলারের সঙ্গে সংঘর্ষে যাত্রী বোঝাই একটি নৌকা ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া নৌকাটি বিজয়নগরের চস্পকনগর নৌকাঘাট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের আনন্দবাজার নৌকাঘাটের দিকে আসছিল। এই দুর্ঘটনায় ২২ জনের মৃত্যু হয় ও আহত হন ১০/১২ জনের মতো। এই দুর্ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারকে নগদ টাকা প্রদান করা হয়। সরকারের কাজ এতটুকু পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।
সরকার যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে একই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে বরগুনার ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী এলাকায়। বিগত ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাত ৩ টার দিকে সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে দগ্ধ হয়ে নারী-শিশুসহ মোট ৪৯ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে ও শতাধিক লোক গুরুতর আহত হন। এই ভয়াবহ ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে স্রেফ ঝালকাঠি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়।
২০২২ সালের ২৯ জুলাই বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী ‘মহানগন প্রভাতী এক্সপ্রেস’ ট্রেনের চট্টগ্রামের মিরের সরাইয়ের বড়তকিয়া এলাকার লেভেল ক্রসিংয়ে পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাসের ধাক্কা লাগে। ট্রেনটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে মারা যান ১১ জন যাত্রী ও আহত হন সাতজন। এই সাতজনের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয় চিকিৎসাধীন অবস্থায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও ট্রেনের যাত্রীদের ভাষ্য, ঘটনাস্থলে গেটম্যান না থাকায় লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো সিগন্যাল বা প্রতিবন্ধক ছিল না। ফলে এই আকস্মিক ঘটনাটি ঘটে।
২০২২ সালের ১৫ আগস্ট বিকাল ৪ টা ২০ মিনিটের দিকে রাজধানীর উত্তরার প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে বিআরটি প্রকল্পের এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের গার্ডার ক্রেন দিয়ে সরানোর সময় তা একটি প্রাইভেট কারের ওপরে পরে। প্রাইভেটকারে থাকা শিশুসহ পাঁচজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। পথচারীদের অভিযোগ ক্রেনটির সক্ষমতার অভাবেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকার গুলিস্তানের বঙ্গবাজারে সকাল ৬ টার দিকে একটি পোশাক মার্কেটে আগুন লাগে। আগুন লাগার প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে। অগ্নিকান্ডে শত শত দোকান ভস্মীভূত-যেখানে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। বস্তুত অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে মার্কেটটিকে চার বছর আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
বঙ্গবাজারের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা রেশ না কাটতেই প্রায় একই কারণে বিগত ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯.৫০ মিনিটে রাজধানীর ঢাকা শহরের বেইলি রোড এলাকার ‘গ্রিন কেজি কটেজ’ নামক একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়। ঘটনায় ৪৬ জন মৃত্যুবরন করেন এবং আহত হন প্রায় ১০/১৫ জন। ভবনটিতে একাধিক রেস্তোরা ও দোকান ছিল। পুরো ভবনের প্রতিটি তলায় রেস্তোরা থাকায় ভবনে গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ রাখা ছিল, যার ফলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সাভির্স ও স্থানীয়দের প্রচেষ্টার রাত ১২ টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
২০২৫ সালের ৬ আগস্ট ভোরে নোয়াখালীতে লক্ষীপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়ক এলাকায় মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ৩০ মিটার গভীর খালে পরে একই পরিবারের ৭ জন মারা যায়। অভিযোগ রয়েছে, চালক ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
উল্লেখিত প্রতিটি দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, চালকের গাফিলতি, ওভারলোডিং-ওভারটেকিং-ওভারস্পিড, পরিবহনের নিয়ম-নীতি না মানা, ফিটনেসবিহীন পরিবহন, সক্ষম যন্ত্রপাতির অভাব, দাহ্য-রাসায়নিক পদার্থ ও গ্যাসসিলিন্ডার যত্রতত্র রাখা, বিল্ডিং কোড না মানা, প্রচলিত নিয়ম-নীতি না মানা, চালকা ও সহযোগীর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকা, সিঙ্গনাল না মানা, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ও বৈদ্যুতিক শটসার্কিট, দুর্নীতি ও দুর্ঘটনার জন্য দায়ি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ শাস্তি না দেওয়ার কারণে প্রতিবারই নতুন করে একই ধরণের অপ্রত্যাশিত অশুভ ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর উদ্ধার কাজে তেমন গতি লক্ষ করা যায় না। মূলত অপ্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী, তথ্যপ্রবাহের অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং জনসচেনতা অভাবের কারণে এমটি হয়ে থাকে। এছাড়া অনেক সময় সাধারণ মানুষ উদ্ধার কাজকে ব্যাহত করে, ভিড় জমায় এবং দুর্ঘটনার ছবি তোলা বা লাইভ করার মতো হুজুকে মেতে ওঠে। এছাড়াও দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও দায়িত্ববর্হিভূত পেশাজীবীদের অনধিকান প্রবেশ উদ্ধার ও চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত করে।
সুতরাং উদ্ধার কার্যে গতিশীলতা আনার জন্য দুর্ঘটনার পরবর্তী সময়ে উদ্ধাকারী দল, অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশ বিভাগের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কাজে সহায়তা করতে এবং দায়িত্বশীল আচরণ করতে উৎসাহিত করতে হবে।(চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized