১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলারদেশে প্রত্যাগমন করেন। ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই দিনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে রাষ্ট্রপতি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কি কারণে তিনি সরাসরি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ না করে, তাজউদ্দীনকে অব্যহতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তা অনেকটাই রহস্যজনক। তবে ধারণা করা হয়, দিল্লীর ইঙ্গিতেই এমন স্বৈরতান্ত্রিক কাজটি করা হয়েছিল।
১৯৭২ সালের ১২ মার্চ হতে ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারের কাজ শুরু হয় এবং ১৫ মার্চ তা সম্পন্ন হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, ভারতীয় বাহিনী নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সময় বাঙালির অকৃতিম ভালবাসাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অনৈতিক ও অমানবিকভাবে এদেশের বিপুল সম্পদ লুটপাট করে নিজ দেশে নেওয়া শুরু করে! সেই লুন্ঠন ছিল বিভৎস-বেপরোয়া ও পরিকল্পিত। সেই লুন্ঠন একটি সচেতন প্রতিক্রিয়ারই ধারাবাহিক কর্মতৎপরতা। পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক পরিত্যক্ত কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক গাড়ী, অস্ত্র, গোলারুদসহ আরো অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকে বোঝাই করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ‘প্রাইভেট কার’ রিকুজিশন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের জমাকৃত অস্ত্রও তারা নিয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় বাহিনীর এমন ব্যাপক লুন্ঠন জনগণকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল।
এসময় কিছু ভারতীয় আর্মি অফিসার ও তাদের অধিনস্ত সিপাহীরা যশোর, কুমিল্লা, ঢাকা, জয়দেবপুর, চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ও গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ ও খুলনা শিল্পাঞ্চলে ব্যাপক লুটপাট শুরু করে। সেই সময় ভারতীয় বাহিনী সদ্য স্বাধীন দেশে সর্বব্যাপী যে নজিরবিহীন লুটপাট চালায় তা বিদেশীদেরকেও বিহ্বল করে। এই লুটপাটের কাহিনী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ওই সময়কার বিখ্যাত বৃটিশ দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য গাডিয়ান’-এ এই লুটপাট সম্পর্কে একটি প্রাতিবেদন ছাপা হয়েছিল। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ ১৯৭২ সালে ভারতীয় সেনারা নিজ দেশে প্রত্যাগমনকালে ১২ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানী বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র, খাদ্যশস্য, পাট, সুতা, যানবাহন, সমুদ্রগামী জাহাজ, বিভিন্ন মিল-ফ্যাক্টরির মেশিনপত্র, যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লুট করে। এই বাহিনী এতই নির্লজ্জ ছিলো যে এতো কিছু নিয়ে যাবার পরও কর্ণেল-ব্রিগেডিয়ার র্যাঙ্কের অফিসারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে টিভি, রেডিও, ফ্রিজ, আসবাবপত্র, ক্রোকারীজ সামগ্রী ট্রাকে করে ভারতে পাচার করে।’
ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক এই লুন্ঠিত সম্পদের পরিমান তৎকালীন মূল্যে ছিল প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। লুন্ঠিত এই মালামাল ভারতে পরিবহনের জন্য হাজার হাজার সামরিক যান ব্যবহার করা হয়েছিল। লুটপাটের সুবিধার্থে প্রয়োজনে ভারতীয় সেনাকর্মকর্তারা এলাকায় সান্ধ্য আইনে জারি করতো। মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের এই ভয়াবহ দৃশ্য শুধু অসহায়ের মতো অবলোক করেছে ; কারোরই প্রতিবাদ করার কোনো সাহস ছিল না। আর যারা এর প্রতিবাদ করেছে, তাদেরকে আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী কর্তৃক চরম শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
দেশের সস্পদ রক্ষা করা প্রতিটি দেশপ্রেমিক সরকারের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটা দেশপ্রেমেরই অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সেই মহান দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তাই তাদের এই ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ও ওই সময়কার ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবৈধ লুন্ঠন ও ডাকাতিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য আমাদের দেশের কিছু ভারতীয় চাটুকারেরা বলতো ও এখনো বলে, ‘এসব সামান্য ঘটনাকে ভুলে যাওয়া উচিৎ ; ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যথেষ্ট অবদান আছে, যা কখনো অস্বীকার করা যাবে না। এই ঋণ কখনো পরিশোধ করা যাবে না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জুগিয়েছে, শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবার দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং আন্তর্জাতিক সমথর্ন আদায়ে সহায়তা করেছে। এছাড়াও ভারতীয় সেনাবহিনী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং ১২ থেকে ১৪ হাজার সৈন্য যুদ্ধে নিহত হয়েছে।’
এসব আবেগ প্রবণ বক্তব্য খন্ড করে বলা যেতে পারে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে শক্র ও মিত্র রাষ্ট্রের সংজ্ঞা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। উদাহরন স্বরূপ ইরান-ইসরাইলের কথা বলা যেতে পারে। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তাদের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছিল ; কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে তাদের এই সম্পর্ক আস্তে আস্তে ম্লান হতে থাকে। অবশেষে ২০২৫ সালের ১৩ জুন থেকে তাদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যা এখনো পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
আসলে একাধিক কারণে ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। প্রথমত, ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত দ্বিখন্ডিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছিল। অখন্ড ভারত বিশ্বাসী ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কখন সাফল্যের সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের বিলোপ ঘটানো যায়। পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলোপ না হলেও বরং তার রাষ্ট্রীয় অঙ্গচ্ছেদের সুবর্ণ সুযোগই ১৯৭১ সালের এক মহাক্ষণে ভারতের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়। দ্বিতীয়ত, ১৯৬২ সালের শেষার্ধে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় চীন-ভারত যুদ্ধ প্রমাণ করেছিল যে, চীন-ভারত বৈরিতা ও চীন-পাকিস্তান মৈত্রীর পটভূমিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অঙ্গ পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব ভারতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এর অবশ্যম্ভাবী কার্য করণেই ভারতকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে আসাম-নেফা সীমান্তে দেশরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। তৃতীয়ত, আসাম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মনিপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি ভারতীয় পার্বত্য এলাকাবাসী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত। পূর্ব পাকিস্তান এসব পার্বত্য উপজাতীয় বিদ্রোহী গেরিলা বাহিনীর মুক্তচারণ ভূমি ও আশ্রয়স্থল। চতুর্থত, পূর্ব পাকিস্তানের বর্ধনশীল পাট শিল্প বিশ্ববাজারে ভারতীয় পাট শিল্পকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। পঞ্চমত, ভারতীয় বর্ধিষ্ণু শিল্প কলকারখানার শিল্পজাত দ্রব্যের নিরাপদ বাজার অন্বেষণ। এসব কারণেই ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ ভারত সরকার ভারতীয় জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধকে সর্বোতভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দানের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে।
বস্তুত, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে পঙ্গু করে ভারতের পুতুল রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যই সদ্য স্বাধাীন বাংলাদেশে জাতীয় সরকার গঠন না করার ব্যাপারে ভারত পরামর্শ দিয়েছিল ও ১৯৭২ সালে মার্চের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজ দেশে ফেরার সময় আমাদেরদেশে ব্যাপক লুটপাট করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারত অর্থনৈতিক, সামরিক, কৌশলগত ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছে। এ কারণে দেশটি তার নিজেদের স্বার্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সম্পুক্ত হয়, আমাদের স্বার্থে নয়। তারপর কি আমরা বলবো-ভারত আমাদেন শক্র নয়, মিত্র ; মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ও ঋণ কখনো পরিশোধ করা যাবে না!! (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com