
অনেকদিন পর। হ্যাঁ, সত্যিই দীর্ঘ ৪০ বছর পর আমরা স্কুল জীবনের বন্ধুরা আবার একসাথে মিলিত হলাম! জীবনের ব্যস্ততা, পেশাগত নানা টানাপোড়েন, সংসার আর সমাজের দায়িত্বের বেড়াজাল পেরিয়ে যেন ফিরে পেলাম সেই সোনালী দিনের-যখন আমরা ছিলাম-কেবল অন্তরঙ্গ বন্ধু ও আত্মার আত্মীয়।
উল্লেখ্য, গত ৮ আগস্ট আমাদের প্রাণের বিদ্যাপিঠ ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি হাই স্কুল, আখাউড়ার ১০০ বছর পূর্তির প্রস্তুতিমূলক সভা স্কুলের হলরুমে অনুষ্ঠিত হয়েগেল। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, শারীরিক অসুস্থতার জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠানটিতে যোগ দিতে পারিনি। তবে পরের দিন জানতে পারি, বন্ধুবর মনিরুল ইসলাম মনু ও মাজহারুল ইসলাম বাবুল উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য আখাউড়ায় এসেছিলেন এবং এখনো আখাউড়ায় অবস্থান করছে। খবরটি শোনার পর আমার মনটে ছটফট করছে তাদের সাথে দেখার করার জন্য। তাদের সাথে দেখা হচ্ছে না প্রায় ৪০ বছর হতে চলছে! উল্লেখ্য, মনিরুল ইসলাম মনু ‘৭৮-ব্যচের এর ছাত্র। তবে সে আমার সাথে ১৯৮১ সালে এসএসসি সম্পন্ন করেছেন এবং আমরা একই সাথে ঢাকা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম। সেই সুবাদে সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু আমার সেজভাই মো. নাজমুল আশরাফ খানের সহপাঠি হওয়ার কারণে তাকে ভাইবলে সম্বোধন করি। সে বর্তমানে বান্দরবান শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আর আমার সহপাঠি বাবুল বর্তমানে সিলেট শহরে বসবাস করছেন।

এমতাবস্থায় পরের দিন শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে হন্তদন্ত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে চলে আসি। কিন্তু স্টেশনে আসার পর জানতে পারি, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে তিন ঘণ্টা পর ‘মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেস’ ট্রেন স্টেশনে আসবে। এমন প্রতিকূল অবস্থায় তড়িঘড়ি করে বাস যোগে রওয়ানা দেই আখাউড়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিধিবাম সুলতানপুর আসার পর বাসটির স্ট্যাট বন্ধ হয়ে যায়! এরূপ বিরূপতায় মনে বার বার প্রশ্ন জাগছে, তাহলে কি মনু ভাই ও বাবুলের সাথে আমার আর আপাতত দেখা হচ্ছে না? অতঃপর সিএনজি যোগে সকাল সাড়ে দশটায় আখাউড়া পৌঁছি। প্রায় ১০ মিনিট পর আখাউড়া পোস্ট অফিসের চত্বরে মনু ভাই ও বাবুলের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় ও আমার দীর্ঘ উৎকন্ঠার অবসান ঘটে। আমাদের এই দেখা হওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই কঠিন।
এরপর আমরা চুটিয়ে আড্ডা দেই ঢাকা হোটেলে। এখানে আড্ডা চলে একনাগাদ সাড়ে বারটা পর্যন্ত। তারপার আমরা আড্ডা দিতে যাই ফজলুল হক মন্টু ভাইয়ের বাসায়। মন্টু ভাই ছিলেন ‘৭৬-ব্যাচের ছাত্র। আমাদের বড় বোন নাদিরা বেগমও ছিলেন একই ব্যাচের রেলওয়ে স্কুলের শিক্ষার্থী। আমাদের এই আড্ডায় এক এক করে আসেন-বন্ধুবর ইকবাল হোসেন বেলাল, জাহাঙ্গীর আলম ও দেবব্রত বণিক পরিমল। কিন্তু অন্যরা আখাউড়ায় না থাকার কারণে আমাদের এই মধুর আড্ডায় আসতে পারেনি।
আমারদের এই মধুর আড্ডায় সবাই স্মৃতিকাতর হয়েপরি। সবাই পূর্বের স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। স্কুল পালিয়ে বরিশলের বিলে নৌকা চালানো, বর্ষাকালে তিতাস নদীতে মাছ ধরা, রবিবার দলবেঁধে মায়াবি সিনেমা হলে মর্নিং শো দেখা, শীতকালে দ্বীপের মাঠে ক্রিকেট খেলা, ছুটির দিনে আজপুরের বনবাদারে ঘোরাঘুরি, স্কুলে আনোয়ার হুজুরের বেতেরবারি ইত্যাদি নস্টালজিক আলোচনায় আড্ডা জমজমাট হয়ে ওঠে। ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করে আনন্দ লাগছে, আবার কিছুটা বিষন্নতারও সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের এই স্মৃতিকাতর আলোচনা চলে দুপুর ৩ টা পর্যন্ত। কখন যে এত সময় পার হয়েগেল টেরই পাইনি।
এইদিকে শ্রদ্ধেয় ফজলুল হক মন্টু ভাই উনার বাসায় সবার জন্য মধ্যাহৃভোজের আয়োজন করেন। আমরা মন্টু ভাইয়ের আমন্ত্রণে খাবার শুরু করি। খাবার টেবিলে সাজানো ছিল হরেক রকম খাবার। কিন্তু সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল আমাদের গল্পগুলো। স্কুলের এসেম্বলি ফাঁকি দেওয়া, স্কুল ফাঁকি দিয়ে সেটেল ট্রেনে চড়ে আজমপুর স্টেশনে গিয়ে আড্ডা দেওয়া, আজহার স্যারের মার থেকে বাঁচার জন্য ফজেলে আলী স্যার থেকে ছুটি নেওয়া, বই ডেস্কের মধ্যে রেখে তা দেখে সিরাজ স্যারের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, কবীর স্যারের কাছ থেকে সহিভাবে আরবী শিখা, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করার পরও অভিভাবকের নিকট কে কি করে ধরা খেয়েছিল-সব উঠে এল একে একে। হাসতে হাসতে চোখ ভিজে উঠল বারবার।

মধ্যাহৃভোজ সম্পন্ন করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকাল ৪ টার দিকে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আমরা অটোরিকশা যোগে আখাউড়ার উত্তরদিকে চাঁনপুর সীমান্ত এলাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। আমরা খালাজুড়া বন্দ(ধান জমি)-এর বুকচিড়ে কল্যাণপুর গ্রামের দিকে যাচ্ছি। খালাজুড়া-কল্যাণপুরের রাস্তাটি নতুন হেয়েছে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি মেহগনী-আকাশী ও কেরুই গাছ। চারদিকে ছায়া সুশীল ও সবুজের সমারোহ। বর্ষাকাল হওয়ার কারণে চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে। আকাশে উড়ে যাচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। স্কুল জীবনে বর্ষাকালে খালুজুড়া বন্দে এসে প্রচুর মাছ ধরেছি। কালের পরিক্রমায় সেই ছোটবেলার দৃশ্য এখন সচরাচর দেখা যায় না। সময়ের ধারাবাহিক পরিবর্তনের ছোয়া এখানেও লেগেছে। এখন খালাজুড়া ধানজমিগুলো মাটি ও বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে নতুন নতুন বাড়িঘর তৈরি জন্যে। হয়তো ভবিষ্যতে নগরায়নের কারণে এই খালাজুড়া বন্দটিও বিলিন হয়ে যাবে।
এইদিকে আমাদের বহনকারী অটোরিকশায় চলছে-গল্প, গান, কবিতা আবৃত্তি আর সেলফির জমজমাট আসর। প্রায় ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই আমরা চাঁনপুর খেলার মাঠে পৌঁছি। অতঃপর পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ-ভারত নোম্যান্সল্যান্ড এলাকায় যাই। ওপাড়ে রয়েছে আগড়তলা বিমান বন্দর। বিমান বন্দরটি তৈরি হয়েছিল ২য় মহাযুদ্ধের সময়। মিত্রবাহিরীর সুবিধার্থে তড়িঘড়ি করে বিমান বন্দরটি তৈরি করা হয়েছিল। এটি তৈরি কালে আমাদের বাবা শ্রদ্ধেয় মো. শমসের খান সাহেব এখানে বেশ কিছু দিন কনস্ট্রাকশন সুপারভাইজারের চাকরি করেছিলেন। শুরুতে বিমান বন্দরটির নাম ছিল সিঙ্গারবিল বিমান বন্দর আর হাল আমলে এর নাম বীর কিশোর মাণিক্য বাহাদুর বিমান বন্দর।
নোম্যান্সল্যান্ড এলাকাটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে অল্প কিছুক্ষণ এখানে অবস্থান করে আমরা পুনরায় অটোরিকশা যোগে আখাউড়ার নাসরিন নবী উচ্চ বলিকা বিদ্যালয় চত্বরে চলে আসি। উল্লেখ্য, বন্ধুবর দেবব্রত বণিক পরিমল দীর্ঘ দিন যাবৎ সুনামের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছে। তার খাস কামরায় কিছুক্ষণ আমাদের জমজমাট আড্ডা চলে ; বিকাল ৬ টার দিকে আমাদের মধুর আড্ডার সমাপ্তি ঘটে। এরপর আমি সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ‘মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেস’ ট্রেনে চড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রত্যাগমন করি।
বলাবাহুল্য, এই একদিনের মিলন যেন আমাদেরকে নতুন প্রাণ দিল। কারো মাথায় চুল নেই, কারো ১/২ টি দাঁত নেই, কারো চুল সস্পূর্ণ সাদা হয়ে গেছে, কারো চোখ অপারেশন হয়েছে, কারো হার্ট অপারেশ হয়েছে, কেউ মোটা হয়ে গেছে, কেউ দাঁড়ি-গোফ রেখেছে, কারো চেহারায় সময়ের রেখা স্পষ্ট-তবুও ভেতরের মানুষটা ঠিক আগের মতোই আছে।
বস্তুত, সময় অনেক কিছু বদলায়, কিন্তু বন্ধুদের কাটানো মুহূর্তগুলো রয়ে যায় অমলিন। সেই মুহূর্তগুলোই জীবনকে আবার নতুন করে বাঁচতে শেখায়। সত্যিই শৈশবের বন্ধুদের সাথে আজকের এই সময় কাটানোর সুহূর্তগুলো ছিল বেশ স্পেশাল ও জীবনের মূল্যবান সস্পদ। কেবলমাত্র আমাদের মতো বন্ধু পাগলরাই এই মূল্যবান সম্পদ অর্জন করতে পারে, অন্যরা নয়।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized