বলাবাহুল্য, সড়ক-রেল-নৌ ও আকাশপথে দুর্ঘটনা, ভূমিধস, অগ্নিকান্ড, দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সাধারণত স্থানীয় বাসিন্দা অথবা পথচারীরা দুর্ঘটনাস্থলে প্রথম উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ করেন। তারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কোনো রকম প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং দুর্ঘটনায় পতিত অসহায় মানুষদের বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য তৎক্ষনাৎ যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। অতঃপর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত কাছের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যান এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসা শেষে আহত ব্যক্তি সুস্থ হলে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাই সড়ক-রেল-নৌ ও বিমানপথে দুর্ঘটনা, অগ্নিকান্ড, ভূমিকম্পসহ দুর্ঘটনা বা প্রকৃতিক দুর্যোগের শিকার ব্যক্তিদের মৃত্যু ও বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি এড়াতে স্থানীয় অধিবাসী ও পথচারীদের ভূমিকা অপরিসীম। অথচ, তাদের সুরক্ষার জন্য আমাদের দেশে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই! সুতরাং এসব মহৎ প্রাণ স্বেচ্ছাসেবীদের পুলিশি হয়রানি ও আদালতের ঝামেলা থেকে রক্ষার জন্য উন্নত দেশগুলোর মতো ‘গুড সামারিটান’ আইন প্রণয়ন হওয়া অত্যান্ত জরুরি।
বাংলাদেশে দুর্ঘটনা ও প্রকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যু অবিরাম এবং অবাধ। এখন প্রশ্ন হলো-এসব অকালমৃত্যু কি দুর্ঘটনা নাকি কাঠামোগত হত্যাকান্ড? সড়ক-নৌ-রেল ও আকাশপথে দুর্ঘটনা, কর্মস্থলে অপ্রত্যাশিত ঘটনায়, আগুনে পুড়ে, রাসায়নিক বিস্ফোরণে ও প্রকৃতিক দুর্যোগে অসংখ্য মানুষ নিহত ও জখম হচ্ছে প্রতিবছর। জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার মানুষ বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় মারা যায় এবং ২ লক্ষ ৪১ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি পঙ্গত্ব বরণ করে। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রানের জন্য রাষ্ট্রের উচিত প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকর সংস্কার করা।
‘সুস্থ, স্বাধীন এবং স্বাভাবিক মৃত্যু’-এই দুটি বিষয় প্রতিটি মানুষের ন্যায়সংগত অধিকারের অন্তভু্র্ক্ত। সুস্থ ও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা একটি মৌলিক মানবাধিকার, যা মানুষের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে স্বাভাবিক মৃত্যু জীবনচক্রের একটি অনিবার্য অংশ এবং এটিও মানুষের একটি ন্যায়সংগত চাওয়া। সুতরাং দুর্ঘটনাজনিত অস্বাভাবিক মৃত্যু কোনো মানুষেরই কাম্য নয়। মানুষ চায় সুস্থ-স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে । তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্ঘটনা ও প্রকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত অস্বাভাবিক মৃত্যু ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ জোরদার করা খুবই প্রয়োজন।
এমতাবস্থায় সবার আগে সড়ক-নৌ-রেল ও আকাশপথ, কলকারখানা, স্কুল ভবন, মার্কেট, ঘরবাড়ি এবং অফিস-আদালতে আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অবাধে গাছ ও পাহাড় কাটা এবং জলাশয় ভরাট প্রতিহত করা। পরিবহন চালক ও সহযোগীকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তাদেরকে সিঙ্গনালসহ প্রচলিত আইন-কানুন মানতে বাধ্য করা। ফিটনেসবিহীন পরিবহন ও মান্দার আমলের যন্ত্রপাতি ব্যবহার চিরতরে পরিহার করা। যত্রতত্র দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ রাখলে দুষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ জরিমানার ব্যবস্থা করা। দমকলবাহিনী ও ডুবুরীদলকে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা। দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা তৈরি করে প্রথম প্রহরে কার্যকর পদক্ষেপের জন্য র্যাপিড রেসপন্স টিম গঠন করা আবশ্যক। সড়ক ও নগর পরিকল্পনায় দুর্যোগ মোবাবিলার দিকগুলো বাধ্যতামূলকভাবে সংযোগের ব্যবস্থা করা। আর প্রতিটি কাজে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে দুর্ঘটনা-পরবর্তী তদন্ত প্রতিবেদন কখনো আলোর মুখ দেখে না! প্রায়শই তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তাদের সুপারিশগুলো কার্যকর ও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয় না, যার ফলে একই ধরণের দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় বারবার ঘটছে। তবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে এই ভয়াবহ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সুতরাং দুর্ঘটনা-পরবর্তী তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে। ব্যর্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রশিক্ষণ ও সচেনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
বস্তুত, বিগত দিনগুলোর ভয়াবহ দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে জানান দিচ্ছে-দুর্ঘটনার পর ছবি তোলা, কান্নাকাটি করা, শোক পালন করা, ক্ষতিপূরণ দেওয়া, পতাকা অর্ধনিমিত করা, দায়সারা গোছের তদন্ত করা, টিভিতে জমজমাট টকশো করা কখনো দুর্ঘটনা প্রতিরোধের টেকসই সমাধন নয়, টেকসই সমাধানের জন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ, প্রতিটি মানুষের জীবন, সস্পত্তি ও স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের একটি অমোঘ দায়িত্ব ; রাষ্ট্র এই দায় কখনো এড়াতে পারে না। (সমাপ্ত)।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized