২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পরিবর্তিত বাংলাদেশকে কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে পারেনি ভারত। ভারতের দাসত্ব থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ যাতে কোনোভাবেই মাথা উচু করে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য নানা কৌশল ও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে আবার দেশে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে চলতে থাকে নয়াদিল্লীর গভীর ষরযন্ত্র। কিন্তু ছাত্র-জনতার দাবির মুখে ১০ মে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে এই নিষিদ্ধ ঘোষণার পর তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতা থেকে হটাতে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সরকারের বিরুদ্ধে ইন্ধন দেওয়ার চেষ্টা করছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট রাতে আনসার বাহিনীকে দিয়ে সচিবালয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার চেষ্টা কেরেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ও নয়াদিল্লী অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দা ফেলার জন্য দীর্ঘ নয় মাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনকে দিয়ে প্রায় হাজার খানেক আন্দোলন করিয়েছে। প্রসঙ্গত, ২৪ মে থেকে ‘সরকারি চাকরি(সংশোধন) অধ্যাদেশ,২০২৫’ প্রত্যাহারের দাবিতে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে সচিবালয়ের ভেতর বিক্ষোভ করছে বিভিন্ন মন্ত্রনালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। ধারণা করা হচ্ছে, এখানেও পাতিত আওয়ামী লীগ সরকার ও নয়াদিল্লীর পরোক্ষ ইন্ধন রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কতিপয় রাজনৈতিক দলের নির্বাচন ভিত্তিক আন্দোলন।
এসব অবস্থার প্রেক্ষিতে ২৪ মে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। এ অবস্থায় সব দেশপ্রেমিক মহল থেকে অনুরোধ আসতে থাকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি পদত্যাগ না করার জন্য। অতঃপর দেশ ও জনগণের বৃহৎ স্বার্থে দেশবিরোধী সকল ষরযন্ত্র মোকাবিলায় প্রধান উপদেষ্টা ২৫ মে থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেন। এ বৈঠকে সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী গোষ্ঠী সমর্থন দেয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখার বিষয়ে।
উল্লেখ, জাতির চরম ক্রান্তিকালে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন অন্য কোনো ব্যক্তি ছিল না এই দায়িত্ব গ্রহণ করার। ওই সময় চারদিকে ছিল ঘোর অন্ধকার ও ষরযন্ত্র। পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ও নয়াদিল্লীর এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে, ওনাকে ডিসক্রেডিটড করতে,ওনাকে ব্যর্থ করতে।
আর দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অসংখ্য মানুষ ষরযন্ত্র করে যাচ্ছে, অধ্যাপক ইউনূসের সফলতার বিরুদ্ধে ; উনার সফলতা দেখলে তাদের শরীরে ফুসকা পড়ে। উনি সফলহলে তো দেশ সফল, কারণ তাদের কাছে তো দেশের চেয়ে দল আর দলের চেয়ে নিজের স্বার্থ বড়। উনিই এখন অনেকের স্বার্থের বড় প্রতিবন্ধক, তাই যেকোনো মূল্যে উনাকে সরাতেই হবে। উনি সফল হলে তো তাদের রাজনীতিই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
ড. ইউনূস বিদ্বেষী ও তাকে নিয়ে বেশুমার কাদা ছোড়াছুড়ি করাই যাদের অন্যতম কাজ, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি-গত ২৯ মার্চ ৪ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীন যান ড. ইউনূস। ওই সফরের সাফল্যের কথা দয়া করে শুনুন-১৫ হাজার কোটি টাকার বিশ্বমানের মেডিকেল প্রতিষ্ঠা, ১২ হাজার কোটি টাকার চারটি মহাসাগরীয় বাণিজ্য জাহাজ ক্রয়, ১০ হাজার কোটি টাকার তিস্তা ব্যারেজ তৈরি, বিনা শুল্কে ২০২৮ সাল পর্যন্ত পণ্যবাণিজ্যসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির ১ ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তি হতে যাচ্ছে।
এছাড়াও গত ২৬ মার্চে অধ্যাপক ইউনূসের তৎপরতায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন ও এ নিয়ে চলমান সংকট সমাধান সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ১৪১ দেশ এই প্রস্তাবে ভোট দেয় ও ১০ টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। তবে বিপক্ষে কোনো রাষ্ট্র ভোট দেয়নি। ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব গুরুপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রোহিঙ্গাদের আগে যেখানে খাবার বাবদ মাসিক ৭ ডলার, তথা ৮৪৭ টাকা দেওয়া হতো, সেখানে নতুন বাজেটে সেটি বাড়িয়ে এখন থেকে জনপ্রতি খাবারে ১২ ডলার, তথা ১৪৫২ টাকা দেওয়া হবে। তাছাড়া বিশ্বের ৭৫ তম দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুট হওয়া ব্যাংকগুলোর নিশ্চিত ধ্বংস হতে রক্ষা করেছেন। পুরো রোজায় কোনো জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি এবং পুরো রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ পূর্বের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। আদানির কাছে বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন থেকে রক্ষা করেছেন, এখন রিজার্ভ তরতর করে বাড়ছে, রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং ডলারের দামের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।
রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের বেশি হয়েছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে তার সময়। বিগত বছরগুলোয় বর্ডার কিলিং গড়ে বছরে ৫০০-এর অধিক ছিল। গত বছর ছিল ৫৭৭ জন। তবে ড.ইউনূস সরকারের সময় তা ৭ মাসে ১০ জন। দেশটাকে রাজ্য থেকে আবার রাষ্ট্রের মর্যাদায় আসীন করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক সমাদৃত বাঙালিও তিনি। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সৎসাহস রাখেন একমাত্র ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সব সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব একমাত্র তার পক্ষেই আদায় করা সম্ভব হয়েছে। কারণ তিনি সৎ, নির্ভিক ও নিষ্ঠাবান।
বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র তার আমলেই সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ও ডিটিটাল প্ল্যাটফরমে তুমুল সমালোচনা ও তার বিরুদ্ধে কুৎসিত ভাষায় অপপ্রচার করা যাচ্ছে। কাউকে তিনি গ্রেপ্তার করেননি, যা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে কল্পনাও করা যেত না। তিনি প্রবাসীদের ভিআইপির মর্যাদা দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন রেমিট্যান্সযোদ্ধা হিসেবে। আর এই রেমিট্যান্সযোদ্ধাদেরকে ভোটারের তালিকাভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছেন। তার যোগ্য নেতৃত্বে আরব আমিরাতে বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশী কারাগার থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রের প্রতিটি সাংবিধানীক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস হওয়া হাত থেকে রক্ষা করেছেন। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের মেরামত ও সংস্কারের কাজ পুরোদমে চলছে। পতিত স্বৈরাচারী হাসিনার সময়কার প্রতিটি হত্যাকান্ডের বিচারকাজ শুরু করেছেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে পাঠানোর জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে ব্যবস্থা করছেন।
প্রসঙ্গত, ড. ইউনূস ২৭ মে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে জাপান গিয়েছেন। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে ৭ টি সমঝোতা স্মারক সই হবে। এই সফরকালে বাংলাদেশ জাপানের কাছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা চাইবেন। এছাড়াও আগামী ৫ বছরে ১ লাখ বাংলাদেশী কর্মী জাপানে নেওয়ার চুক্তি করবে। আশা করা যাচ্ছে, ড. ইউনূসের এই সফর সার্থক হবে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। একজন বিশ্বনেতা হিসেবে তা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ-বাচনভঙ্গি-উপস্থাপন শৈলী-ইংরেজীতে কথোকথন ও ভাষণ অতুলনীয়! এছাড়াও একজন দক্ষ কূটনীতির মতো অন্য বিশ্বনেতাদের ওপর প্রভাববিস্তার এবং বিশ্ব ফোরামগুলোতে তার আকর্ষণীয় সরব উপস্থিতি ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বাঙ্গনে একটি উল্লেখযোগ্য দেশে পরিণত হয়েছে। পূর্বে আমাদের দেশে এত উচু মাপের নেতা কখনো দেখা যায়নি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে আপাতত অন্য কারো তুলনা করা যাচ্ছে না। বর্তমানে তার কোনো বিকল্পও নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আগেই বিশ্বে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা আজ বাংলাদেশের ইমেজ সঙ্কটের উত্তরণ ঘটিয়ে অপার সম্ভবনা তৈরি করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের লোক না হয়েও তিনি যেভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাতে প্রতিবেশী দেশের কূটনৈতিক অস্ত্র ইতিমধ্যে অকার্যকরই হয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক সস্মেলনের এক ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ড. ইউনূসের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে মুহাস্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিকট বাংলাদেশের বেশ কিছু অমীমাংসিত ইস্যু যেমন-তিস্তা ও গঙ্গার পানিবণ্টন, সীমান্তে বিসএফের বাংলাদেশীদেরকে অহেতুক হত্যাসহ বিভিন্ন মুখ্য ইস্যু তুলে ধরে এর দ্রুত সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ন্যাযতা ও সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। পূর্বে আমাদের দেশের কোনো রাষ্ট্রনায়ক ভারতের সরকার প্রধানের সাথে এভাবে দৃঢ়তা ও সাহসীকতার সাথে দেশর স্বার্থ নিয়ে কখনো আলোচনা করেননি।
সময় যতই যাচ্ছে, ড. ইউনূসের জনপ্রিয়তা ততই বাড়ছে। যে দলই নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, জনগণ তাদের প্রতি মহাবিরক্তি প্রকাশ করছে এবং তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে। কতিপয় রাজনৈতক দল চাচ্ছে, যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন। কিন্তু ড. ইউনূস চাচ্ছেন, আগে রাষ্ট্রীয় সংস্কার, জুলাই হত্যাকান্ডের বিচার ও তারপর সুষ্ঠু নির্বাচন।
দেশের সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সবার উচিত নিঃশর্তভাবে সর্ববিষয়ব্যাপী ড.ইউনূসকে সহযোগীতা করা। এখন আমরা যদি ইউনূসের সরকারকে অর্থবহ সংস্কার ও জুলাই হত্যাকান্ডে যথাযথ বিচার করতে না দেই, তাহলে আমরা এই সুযোগ আর কখনো পাব না। ইতিহাস আমাদেরকে কখনো ক্ষমা করবে না। রাষ্ট্রীয় সংস্কার ছাড়া শুধু একটি নির্বাচন বাংলাদেশের গভীর সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। আমাদেরকে অবশ্যই গতানুগতিক নির্বাচনের মোহ থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত পদ্ধতিগত পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করতে হবে। এমন সংস্কার করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব না ঘটে। এমন সংস্কার করতে হবে, যার মাধ্যমে শুধু রাজনীতিবিদদের নয়, জনগণেরও ক্ষমতায়ন হবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized