মানুষের দীর্ঘদিন এক জায়গায় অবস্থান তাকে মাঝে মাঝে একঘেয়ে ও স্থবির করে দেয়। এই একঘেয়েমি কাটাতে প্রয়োজন হয় বায়ু বদল কিংবা পরিবেশ বদল। এতে করে নতুন প্রকৃতি ও মানুষ দর্শনের দ্বারা তার একঁঘেয়েমিতা কাঁটে। তবে শুধুই যে একঘেয়েমিতা কাঁটিয়ে কর্মচঞ্চলতা বৃদ্ধি পায় তা না কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এ বায়ু বদল দ্বারা তার মাঝে নতুন নতুন চিন্তার উদয় হয়। এমন কি বিশ্ব পরিবর্তনের চিন্তাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। মাঝে মাঝে নিজেকে দেখতে বুঝতে ও শুদ্ধ করতে বায়ুবদল জরুরি হয়ে পড়ে। নিজের স্থির ও একঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্তি পেতে ঈদের ছুটিতে বায়ুবদলের চিন্তা মাথায় আসে।
আরো পড়ুন: বিজয়নগরে অপরূপ `রূপা`য় একদিন
যে চিন্তা সেই কাজ। আমার চিন্তা ও আত্মপরিচয়ের বিষয়ে বিভিন্ন সফরে দেশ দর্শন সম্পাদক জাকির মাহদিনকে সঙ্গী হিসেবে বাছাই করে নেই। কারণ সফরে সঙ্গীর একটা বিশাল প্রভাব থাকে। তাই উনাকে মুঠোফোনে স্মরণ করি। আমি উনাকে আমার সফরের পরিকল্পনা বললাম। আমার পুরো পরিকল্পনা ছিল তিনদিন যে কোনো মসজিদে অবস্থান করা তবে শর্ত ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে সম্পর্কের দ্বারা নিজেকে দেখে কিছু গঠনমূলক চিন্তা করা। তবে উনি হাফেজ হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেও কাজ করতেন এক সময় এবং বেশ কয়েকজন ইমামও পরিচিত ছিল। তাই এ সফরে উনাকে স্মরণ করা। লোকটি আবার দর্শন, সমাজ সংস্কার, রাষ্ট্র সংস্কার, মানুষ সংস্কার নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে যাচ্ছে।
জাকির মাহদিন ভাইয়ের সাথে কথা বলে ২৫ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে বাসে করে রওয়ানা হলাম। পূর্বেই আমাদের দুইজনের সিদ্ধান্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার সীমান্ত এলাকার একটি মসজিদে আমরা অবস্থান করব। উনার পরিচিত এক ইমাম হাফেজ মাওলানা জাবেদ হোসাইন সেখানে একটি মসজিদে দায়িত্বরত। ভদ্র লোকের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকতে বহুদিন পূর্বে আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। উনিও আবার বই লিখেন। তবে আমার আর জাকির ভাইয়ের মত গবেষণাধর্মী লেখা নয়। যা হোক, ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছায়। বহুদিন পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা কেমন যেন নড়ে উঠল। এ শহরের সঙ্গে স্মৃতিগুলো মস্তিষ্ক খুঁজতে শুরু করে দেয়। তবে স্মৃতিকে আমি বেশিক্ষণ নড়াচড়া করার সুযোগ দেয় না। কারণ মুসাফিরের জীবনে স্মৃতির চেয়ে সামনে এগিয়ে চলাটাই মূল লক্ষ্য থাকে।
উনার বাড়িতে পৌঁছে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শিমরাইলকান্দি ঘেষে যাওয়া তিতাসের তীরে কিছুক্ষণ হেঁটে মাগরিবের নামায আদায় করি। রাতে দুইজন সিএনজি যোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাউতলি থেকে কসবা বায়েকের কাশিরামপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাত দশটা বাজে অথচ রাস্তা দিয়ে সিএনজিতে বসে রাতের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিল গভীর রাত হয়ে পড়েছে। অনেক নীরব। মোবাইলের নেটওয়ার্ক পর্যন্ত পেতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে সিএনজিতে বসে দুইজনে একটা বিপদে পড়লাম। জাবেদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। তবে একজন বয়স্ক লোক আমাদের জিজ্ঞেস করে, `কোথায় যাবেন?` আমরা কোনেরেকমে ঠিকানাটা বললাম। উনি খুব সহজেই চিনে গিয়েছিলেন। নিজেই আমাদের এ রাতে কষ্ট করে অনেকদূর পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। লোকটি আন্তরিক ছিল। এর মধ্যে জাবেদ ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে লোকটি জেনে নিল আমাদের কোথায় যেতে হবে। আমাদের উনি সেই মত পথ দেখিয়ে দিলেন। অবশেষে আমাদের দুজনের জাবেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। গ্রামের নির্জন পথ ধরে মাইল দেড়েক হেঁটে উনার মসজিদে যেতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা চলছিল আমাদের মাঝে। আমরা কিছুক্ষণ পরপর ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা দেখি কী যেন নিয়ে যাচ্ছে। জাবেদ ভাইয়ের সাথে গ্রামের বাইশ তেইশ বছরের একটি ছেলে এসেছিল। ও হঠাৎ বলে উঠে এগুলো ভারত থেকে চোরাই পথে আসা চিনির বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ভাই প্রতিদিনই কিছু না কিছু ভারতীয় পণ্য ঢুকে থাকে সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে। তখন হঠাৎ একটা বাইকে দুইজন বিজিবিতে কর্মরত সৈনিক দেখতে পাই। বললাম ওরা কিছু করে না। ওরাতো বস্তা প্রতি টাকা গুণে। আসলে বাস্তবতার সম্মুখীন না হলে অনেক কিছুই গল্প মনে হয়। সরকারের রাজস্ব কর ফাঁকি দিয়ে এ অঞ্চলের লোকজন কোটি কোটি টাকা আয় করছে। অথচ একটি দেশের উন্নয়নে এ ধরনের কার্যক্রমগুলো অনেক বাধাগ্রস্ত হয়।
লেখকের আরও লেখা পড়ুন ওল্ড দেশ দর্শনে
মনে মনে ভাবি, পুরো দেশটাই দুইশ্রেণির দুর্নীতিবাজে ভরপুর একশ্রেণি সরকার বেতন দিয়ে লালন-পালন করছে আরেক শ্রেণি আমাদের সাধারণ জনগণের মধ্যেই। ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটতে জাবেদ ভাইয়ের মসজিদে পৌঁছায়। মসজিদ ও গ্রামের নির্জনতা দুইই আমাদের পছন্দ হয়। এশার নামায পড়ে রাতের খাবার খেয়ে মসজিদের ভেতরে বিশ্রাম নিতে যাই।
চলবে…
শরীফ উদ্দীন রনি
সাংবাদিক, কলামিস্ট
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized
Pingback: আত্মপরিচয় ও আত্মশুদ্ধির সফরে (পর্ব-২) – দেশ দর্শন