ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজে যা বিশ্বাস করতেন তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতেন। ভন্ডামি ও স্ববিরোধীতা কখনো তাঁর জীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি। এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর কোভিড চিকিৎসার সময়। করোনাকালীন সময়ে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তাঁর কোভিডের চিকিৎসা চলছিল। তবে আরও ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলের করোনা ইউনিটে নেওয়ার জন্য তাঁর আত্মীয়স্বজনরা সরকারের নিকট অনুরোধ করেছিল এবং সেই অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাঁর জন্য ঢাকা মেডিকেলের ভিআইপি রুমও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেখানে যেতে রাজি হননি। ওই সময় তিনি আত্মীয়স্বজনদেরকে বলেছেন, যে হাসপাতাল তৈরি করলাম সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য, সেখানে যদি নিজে আস্থা না রাখি, তাহলে তারা এর প্রতি কোন আস্থা রাখবে না-তাঁর এই কথায় অবশ্য যুক্তি ছিল।
নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে ডা. জাফরুল্লাহ ছিলেন একরোখা, নির্ভিক ও মৃত্যুভয়হীন এক তরুণ যোদ্ধা। তাঁর সমস্ত চিন্তা-ভাবনা পরিচালিত হতো সাধারণ জনগণকে কেন্দ্র করে। এখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ কখনো স্থান পেতো না। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা বলছি; এর মাধ্যমে তার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমি ২০২২ সালের শেষেরদিকের কথা বলছি; দিনটি ছিল শুক্রবার ৩০ ডিসেম্বর। বেলা তখন বিকাল ৫ টা। ওই সময় আমার এক বন্ধুর বড়ভাই গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তাঁকে দেখতে সেখানে যাই। গিয়ে দেখী, মৃত্যুর প্রহর গুণা মুমূর্ষ রোগীরা সবাই চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ডা. জাফরুল্লাহকে দেখলাম বেশ ব্যতিক্রম! তিনি ডায়ালাইসিস নেওয়া অবস্থায় হাঁসিমুখে মজার করে খাচ্ছেন, সহকর্মীদের কাজের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং মাঝেমধ্যে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে মোবাইল ফোনে রসিয়ে রসিয়ে আলাপ করছেন! তাঁর মনের মধ্যে কোন হতাশার ছাপ নেই! আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঠিক ওই সময় ডা. জাফরুল্লাহর নিকট আমেরিকা থেকে একটি ফোন আসে। ফোনটি করেছেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেজ্ঞ ডা. এম এ মোবিন। তিনি আমেরিকা বা জার্মানীতে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করার জন্য ডা. জাফরুল্লাহকে বিশেষ অনুরোধন জানান। কিন্তু জাফরুল্লাহ তাতে রাজি হননি। এর আগেও নাকি এধরনের অনুরোধ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া সহ আরো অনেকে করেছিলেন। এতে তাঁর অর্থ ব্যয়ের কোনো ব্যাপার ছিল না! তবে জাফরুল্লাহ
বরবারই তা প্রত্যাখন করেছেন। এর মূল কারণ ছিল-তিনি দীর্ঘ দিন যাবৎ বাংলাদেশের কিডনি প্রতিস্থাপন আইন পরিবর্তনের আন্দোলন করছিলেন। বাংলাদেশের বর্তমান আইন অনুযায়ী কাছের আত্মীয় ছাড়া কেউ কিডনি দান করতে পারে না। এই অবস্থায় অনাত্মীয়কে আত্মীয়ের মিথ্যা পরিচয়ে কিডনি নিতে হয়। এতে গরিব মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। কিডনি সমস্যা জনিত কারণে নিজের মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনেও তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদেরকে বিনয়ের সঙ্গে সব সময়ই বলেছেন, দেশের সাধারণ মানুষ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সুযোগ পাবে না, আর আমি বিদেশ থেকে তা করে আসব বা দেশে মিথ্যা কথা বলে করতে হবে, তা হয় না। এটা স্ববিরোধী কাজ। এধরনের জঘন্য কাজ করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান আইন পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত আমি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করব না!! যতদিন বাঁচি ডায়ালাইসিস করব এবং সেই সেবা গরিব মানুষকেও দিতে পারব। কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে এধরনের ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই দুস্কর ব্যাপার বটে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রজীবনে বাম ধারার রাজনীতি করতেন। ওই সময় তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। তবে পরবর্তী জীবনে কখনো সক্রিয় রাজনীতি করেননি। তারপরও তিনি সব সময়ই স্বাধীন রাজনৈতিক মতামতের মাধ্যমে জনমনে প্রভাব ফেলেছিলেন। পচাঁত্তর সালে বাকশালের বিরোধীতা করেছেন আবার পরবর্তীকালে জেনারেল ওসমানী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ালে তিনি তাঁর হয়ে কাজ করেছেন। ঘনিষ্ঠ ছিলেন বিএনপি ও এর চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সাথেও। পরবর্তীকালে ডঃ কামাল হোরসনের নেতৃত্বে বিএনপিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হলে তাতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। এর মধ্যে আবার আওয়ামী লীগের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয়। আর এই কারণেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলা হয়েছিল। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলাও হয়েছিল। এতকিছুর পরও জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যেকার বিরোধ অনেকটাই কমিয়ে ছিলেন।
আমাদের দেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক কথা হয়। প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করেছিলেন। যে কাজ নারী `পারে না` বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত, সেসব কাজে নারীদেরকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ইলেকট্রিশিয়ান, কারপেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে নারীদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ড্রাইবার হিসেবে নারীদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রথম সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সালের দিকে! বর্তমানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৫০০ এর মতো। অববাক হওয়ার বিষয় এর মধ্যে ৪০ শতাংশই নারী!
কিছু কিছু ব্যক্তি সমালোচনা করে বলে থাকেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সুসম্পর্ক ছিল। কথাটি অসত্য নয়। তবে এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে নিজের জন্য সামান্যতম কোনো সুযোগ-সুবিধা নেননি, নিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য। আর এই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মালিক তিনি নন, তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা মাত্র। এর প্রকৃত মালিক সাধারণ জনগণ। তাই এই প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পদের ওপর তাঁর কোনো অধিকার নেই। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এমন নিলোর্ভ, ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান ছিলেন যে, উক্ত দুই সামরিক শাসকের মন্ত্রীত্ব গ্রহণের প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখান করেছিলেন! আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে মন্ত্রীতেত্বর মতো লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখান করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার বটে!
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অসাধারণ মানুষ ছিলেন। সমাজের জন্য তিনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি ছিলেন গরীবের বন্ধু ও খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি রাজনীতি করতেন না; তবে তাঁর বক্তব্য রাজনীতিকে আন্দোলিত করত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাফরুল্লাহ চৌধুরী লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হতে পারতেন। তাঁর নামে পেছনে দেশী-বিদেশী হরেক রকম ডিগ্রী হয়তো শোভা পেত। কিন্তু তিনি তা করেননি! তিনি শুধু্ এমবিবিএস ডিগ্রীধারী ডাক্তার হয়েই থাকলেন। তবে উচ্চতর ডিগ্রীধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না হয়েও তিনি যে সফলতা অর্জন করেছেন, তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। আজ গণমানুষের ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পরিচিত ও সমাদৃত একটি নাম। এই নাম যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবে এবং মানুষকে ভাল ও সৃজনশীল কাজ করার জন্য সব সময় অনুপ্রেরণা যোগাবে।(সমাপ্ত)।
খায়রুল আকরাম খান
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized
এগুলো তার জন্য ভালো দিক।কিন্তু তিনি সন্তান ও পরিবার গঠনে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।