সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালে সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনা মূলনীতির তৃতীয় স্তম্ভ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ প্রসঙ্গে আসা যাক। গভীর ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিসম্পন্ন বাংলাদেশের জনগণের উপর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আরোপ করার বিষয়টি মোটেই হাল্কা করে দেখার কোন অবকাশ নেই।
ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র নিদির্ষ্ট কোনো ধর্মের অনুসারী নন-সে নিরপেক্ষ ও ধর্মহীন। বাস্তবে কোনো দেশের সংখ্যাঘরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের মৌলিক বিষয়ের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বস্তুত, ধর্মনিরপেক্ষতার মানে হলো, রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে পৃথকীকরণ। এর অর্থ রাষ্ট্র পরিচালনার ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্মকে ভিত্তি হিসেবে না ধরে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।
বর্তমান বিশ্বে যারাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসী তারা কোন না কোন ধর্মের অনুসারী। তাই মুসলমানরা দূরের কথা-অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীও ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করার অর্থ নিজের সাথে নিজের প্রতারনা করার শামিল। কতিপয় নাস্তিক ছাড়া কেউই ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা কিংবা নাস্তিকতা। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বহাল থাকার জন্যই বিবিধ সাম্প্রদায়িক অশান্তি ঘটে চলেছে, যার বীভৎসতম রূপ ২০০২ সালের গুজরাট রাজ্যের মুসলিম নিধন।
কথিত আছে, ১৮ শতকের শুরুতে ইউরোপের ধর্মযাজকদের জুলুম নির্যাতনের খরগহস্তকে নিস্ক্রিয় করার জন্য মজলুম জনতা এই মতবাদের প্রবর্নত করেছিলেন। সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মুসলিম রাষ্ট্রের জনগণের আকিদা-বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্যেও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাব লক্ষ করা যায়। ধর্মনিরপেক্ষতার আধুনিক বিকাশ ঘটে মধ্যযুগের শেষের দিকে। ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে এসে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষ মতবাদ হিসেবে আর্বিভূত হয়।ব্রিটিশ সমাজ সংস্কারক জ্যাকব হলিয়ক ছিলেন আধুনিক সেকু্লানিজমের জনক।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯২ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে না। পৃথিবীর কোনো দেশই তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না। এটাই সত্য ও বাস্তব। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মভীরু এবং কখনোই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি। যুগ যুগ ধরে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে পারস্পারিক সহাবস্থানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে, সেখানে নতুন করে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা মানে তাদের চিরায়ত বিশ্বাসে আঘাত করারই নামান্তর। তাদের বিশ্বাসে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ বাংলাদেশের মুসলিমদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করা। অন্য যে কোনো মুসলিম দেশের চেয়ে বাংলাদেশ চিন্তা-চেতনা ও সহনশীলতায় অনেক এগিয়ে। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধোয়া তুলে কোনো লাভ নেই।
মুসলিম প্রধান দেশ হওয়াতে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিকসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ইসলামের চেতনাবোধ রয়েছে। যে কোন শুভ কাজ শুরুর আগে মুসলমানরা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করে। আত্মবিশ্বাসী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে শেষ করে। কোন কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ‘আলহামদুল্লিলাহ’ বলে। এটা তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা থেকেই বলে। হাজার বছর ধরে আমাদের দেশের মুসলমানদের অন্তরাত্মায় ইসলামি মূল্যবোধের চেতনা প্রোথিত হয়ে আছে। এটা বাংলাদেশের মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলিম প্রধান দেশে ধর্মের প্রাধাণ্য থাকাই স্বাভাবিক এবং এই বাস্তবতা উপেক্ষার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে যে ধর্মীয় উন্মাদনা নেই, তা বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো বহুবার বলেছে। তারা বাংলাদেশকে একটি ‘মডারেট মুসলিম কান্ট্রি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ সফরে এসেও এ ধরণের কথা বলেছেন। অথার্ৎ বিশ্বে সহশীল ও সব ধর্মের মানুষের বসবাসের আদর্শ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে।
এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সামনে বিশ্বে একটি আদর্শ ও আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের রোল মডেল হওয়ার উজ্জ্ব সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য ইসলামী মূল্যবোধ, আচার-আচরণ এবং রীতি-নীতির চর্চা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এখানে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মহীনতার কথা বলছে তাদের কথা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কখনো শোনেনি এবং শুনবেও না। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার পাতা ফাঁদে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ফেলা যাবে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
বস্তুত, একটি দেশের মানুষের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধরে রাখার ক্ষেত্রে ধর্মই মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও ধর্ম সামাজিক ঐক্য-স্থিতিশীলতা এবং মানুষের শারীরিক-মানসিক সুস্থাতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট অবদান রাখে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সংঘাত-সহিংসতা চলছে, তার পেছনে রয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব।
মূলত একটি দেশের পরিচিতি হয় শুধুমাত্র সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের ৫৭ টি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম হলো ‘ইসলামধর্ম’ এবং দেশগুলো মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত।
অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হিন্দু প্রধান দেশ হিসেবে ভারত ও নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করাই স্বাভাবিক। তেমনিভাবে জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারকে বৌদ্ধ প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কেনাডা, ফ্রান্স, ইটালী, ডেনমার্কসহ বিশ্বের খ্রিস্টধর্ম প্রধান দেশও খ্রিস্টনাদের দেশ হিসেবে পরিচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের ধর্মকে প্রাধাণ্য দিয়েই একটি দেশের মূল পরিচয় ফুঁটে ওঠে। স্ব স্ব দেশের সরকারকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মকে প্রাধাণ্য দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে যেখানে ৯২ ভাগ মানুষ মুসলিম, সেখানে তাদের চেতনাকে বাদ দিয়ে ভারতের আজ্ঞাবাহী একটি বিশেষ গোষ্ঠী বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এর শাব্দিক অর্থই হচ্ছে ধর্মহীনতা। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংখ্যাগনিষ্ঠ মুসলমানদেরকে তাদের চিরায়ত ধর্মীয় মূল্যবোধ, আচার-আচরণ এবং সংস্কৃতি থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার এক ধরণের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ধর্মরিপেক্ষতার ধোয়া তুলে ধর্মকে দূরে ঠেলে দিতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। অথচ, যেখানে ভারত বরাবরই তাকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষণা করে আসছে, সেখানেই এখন হিন্দুত্ববাদের জয়জয়কার। অপরদিকে আমাদের দেশে একটি বিশেষ শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের পতনের পরও তারা নেপথ্যে তাদের অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বলা বাহুল্য যে, শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বেশি নির্যাতি ও নিপিড়িত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, যখন দেশে কোন জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, তখন জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নেওয়ার জন্য দেশের মধ্যে সাস্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দিতো। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ অনুযায়ী এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।
প্রসঙ্গত, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা সেকুলারিজম পশ্চিমাদেশে বহুক্ষেত্রে ধর্মাবিরোধীতা অতিক্রম করে ধর্মের সহাবস্থানের জমিন তৈরি করেছে। উদাহরনস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যেতে পারে। সেখানে দেশের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যখন শপথ গ্রহণ করেন, তখন সাধারণত তিনি বাম হাত বাইবেলের উপর রেখে ডান হাত উচিয়ে ধরেন। শপথের শেষ বাক্যে বলেন, ‘সো হেল্প মি গড’। তারা যে কোন সভা-সমাবেশ এই বলে শেষ করেন, ‘গড ব্রেস আমেরিকা’। এমনকি তাদের ডলার, সেখানেও তাদের ধর্মের প্রতি আস্থা এবং ব্যবহার রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে ‘ইন গড ইউ ট্রাস্ট’। অর্থাৎ তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও ধর্মের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে এবং তারা তা মেলে চলেন। এ নিয়ে আমেরিকানদের মধ্যে কোন হইচই দেখা যায় না। এমনকি সেখানে যারা ধর্ম বিদ্বেষী বা ধর্মের নাম শুনলেই রেগে যান, তারাও ধর্মের কথা লেখা ডলারই ব্যবহার করছেন।
অথচ, আমাদের দেশে কিছু লোক ও গোষ্ঠী, যারা নিজেদের অতি প্রগতিবাদী মনে করেন, কেউ ধর্মের কথা বললেই মনে করেন তিনি মৌলবাদী-তারা এ কথা বুঝতে চান না, বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলিম প্রধান দেশে ধর্মের প্রাধাণ্য থাকাই স্বাভাবিক এবং এই বাস্তবতা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized