কোনো কোনো মৃত্যু জীবনকে ছাপিয়ে আরো জীবন্ত করে তোলে। মরেই যেন পুনর্জীবন লাভ করেন। মৃত্যুই তাদের অমর করে রাখে। তেমনি একজন মমতাময়ী শিক্ষকের কথা বলছি। তিনি হলে ঢাকার উত্তরাস্থ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরী। পিতা-মাতার পরে সবচেয়ে বড় অভিভাবক যে একজন শিক্ষক-তিনি নিজের জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করে গেলেন। শিক্ষার্থীদের জন্য জীবন দিয়ে সমাজে সকলের নিকট আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরী। আমাদের দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোতে লেখা হচ্ছে তার আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা।
উল্লেখ্য, গত ২১ জুলাই দুপুর ১টা ১৮ মিনিটের দিকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান উত্তরার মাইলরস্টান স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনার সময়ে ওই ভবনটিতে জুনিয়র শিক্ষর্থীদের ক্লাস চলছিল। বিধ্বস্ত বিমানটি সরাসরি জুনিয়র সেকশনের ভবনে আঘাত হানে।
আঘাতপ্রাপ্ত ভবনটিতে সাধারণত নার্সারি, কেজি, ওয়ান, টু, থ্রি এসব ক্লাস নিয়মিতভাবে হয়। বিমানটি আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ভবন ধসে আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় নিহত হয় ১৮ জন শিক্ষার্থী, স্কুলের একজন স্টাফ এবং প্রশিক্ষক বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফরটন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ ২০ জন ও আহন হন ১৭১ জন।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধ বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনটিতে আঘাত হানার পূর্ব মুহূর্তে প্রাথমিক শ্রেণির ছুটি হয়। এ সময় কিছু শিক্ষার্থী অভিভাবকদের সাথে বাসায় চলে যায় আর বেশ কিছু শিক্ষর্থী অভিভাবকদের জন্য ক্লাস রুমে অপেক্ষ করতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ বিমান বিধ্বস হওয়ায় চারদিকে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। সবাই এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে।
চারপাশে আগুনের গোলা, ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া শ্রেণিকক্ষ এবং শিশুদের আতঙ্কিত কান্না। এমনই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে মহান সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে ত্রাতা হিসেবে উপস্থিত হন-মমতাময়ী শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরী। নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে তিনি এক এক করে প্রায় বিশটি শিশুকে শ্রেণি কক্ষ থেকে অক্ষত অবস্থায় বের করে আনেন!! কিন্তু হ্যায়-অতঃপর তিনি ভেতরেই আটকে পড়েন!! এই গা ছম ছম দৃশ্যই এখন উত্তরার মাইলরস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক রক্তাক্ত ও করুন ইতিহাস। স্বার্থের এই পৃথিবীতে নিশ্চিত মৃত্যুকে উপেক্ষা করে বিশটি অবুঝ শিশুর জীবন বাঁচানো চারটিখাটি কথা নয়-সীমাহীন সাহসের ব্যাপার। এই ভায়বহ বাস্তব দৃশ্য পৃথিবীর যেকোনো সিমানের দৃশ্যকেও হার মানাবে।
মাইলস্টোন স্কু্ল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর পরই প্রায় দুই শ-র অধিক আহত ছাত্র-ছাত্রী,শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদেরকে চিকিৎসার জন্য ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহতদের সবার অবস্থা ছিল খুবই জটিল। কিন্তু এর মধ্য থেকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মমতামীয় শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরী রাত ৯ টা ৪৫ মিনিটে না ফেরার দেশে চলে যান। বিধ্বংস্ত বিমানের আগুনে তার ৮০ শতাংশই পুড়ে ঝলসে যায়।
মৃত্যুর আগে মাহেরিন চৌধুরী চিকিৎসকদের বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান তুল্য শিশুদেরকে আমি বাঁচাতে পেরছি তো’? মৃত্যুর আগে একবারও তিনি জ্ঞান হারাননি! নিজের দুই অবুঝ সন্তানের কথা মোটেই ভাবলে না! শুধু ভাবলেন আহত শিক্ষার্থীদের কথা!-এমন সাহসী, নির্ভিক, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী মহিলা আমাদের সমাজে সচরাচর দেখা যায় না। সত্যিই তিনি আমাদের ভেঙ্গে পরা সমাজের আইডল।
মানুষ গড়ার কারিগর মাহেরিন চৌধুরী দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি ৪৫ বয়সী এই নারী স্কুলটির তিনটি শ্রেণির কো-অর্ডিনেটর হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পাল করেছেন। দীর্ঘ এ সময়ে তার দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সততায় মুগ্ধ ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন দায়িত্বশীল ও অত্যন্ত আপজন।
২২ জুলাই দুপুর দিকে মাহেরিন চৌধুরীর মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সযোগে নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার বগুলাগাড়ী গ্রামে নেওয়া হয়। এ সময় স্থানীয়দের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিকাল ৪ টার দিকে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে মাহেরিন চৌধুরীর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ এতে অংশ নেন। অতঃপর পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
শোকে মুহ্যমান মাহেরিন চৌধুরীর স্বামী মনসুর হেলাল বিভিন্ন গণধ্যমকে জানায়, শিক্ষাবিস্তারে নিবেদীতপ্রাণ মাহেরিন চৌধুরী তার নিজ গ্রামের বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজকে ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মানবতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মাহেরিন চৌধুরী ছিলেন মরহুম মোহিতুর রহমান চৌধুরী ও ছাবেরা চৌধুরী দম্পতির বড় সন্তান। তারা ছিলেন দুই ভাই ও দুই বোন। ১৯৭৯ সালের ৬ জুন মাহেরিন চৌধুরী ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৫ সালে ঢাকার শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও ১৯৯৭ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিতুমীর কলেজ থেকে বাংলায় অর্নাস ও মাস্টার্স শেষ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ২০০২ সালে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। ২০০৮ সালে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চর আত্রাই গ্রামের মনসুর হেলালের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পেশাগতভাবে মনসুর হেলাল একজন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। তাদের রয়েছে দুই ছেলেসন্তান।
পেশাগত কারণে মাহেরিন চৌধুরী ঢাকায় অবস্থান করলেও গ্রামের বাড়িতে তার সব সময় যোগযোগ ছিল। সময়-সুযোগ পেলেই তিনি গ্রামে যেতেন। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শীতের সময় এলাকায় গিয়ে ত্রাণ ও শীতবস্ত্র বিতরণ করতেন। তিনি এলাকার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন।
জীবন প্রতিটি মানুষের জন্য অতিমূল্যবান। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই সব কিছুর চেয়ে নিজের জীবনকে বেশি গুরুত্ব দেন। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু মাহেরিন চৌধুরী ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তিনি জীবনের তোয়াক্কা না করে শিশু শিক্ষার্থীদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তার এই আত্মত্যাগ শিক্ষকতার মহান পেশাকে মহিয়ান করেছে। সত্যিই তিনি ছিলেন ‘মানবতার বীরশ্রেষ্ঠ শিক্ষক’। তার এই আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized