example.com
Verify you are human by completing the action below.
যাকাত ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি। ইসলামী দর্শন অনুযায়ী, যাকাত প্রদানে উপযুক্ত সম্পদের মালিক হয়েও যাকাত আদায় না করলে সে ফাসিক হিসেবে গণ্য হবে। মূলত যাকাত অস্বীকারকারী ব্যক্তি কাফির। বস্তুত মানুষের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়লে সমাজে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়। ফলে মানুষের অভাব অনটন বেড়ে যায়, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিপর্যয় ঘটে। এই সকল সমস্যার সমাধানে মহান আল্লাহ তায়ালা ধনীদের সম্পদের উপর যাকাত ফরজ করেছেন। সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকুক মহান আল্লাহ তায়ালা তা চান না। তিনি চান সম্পদ মানুষের কল্যাণে ব্যয় হোক, সমাজের অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকুক। এই যাকাত একটি ফরজ ইবাদত। তবে এই ইবাদত সবার উপর ফরজ নয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের ওপরই যাকাত ফরজ হবে যারা সাহেবে নিসাব অর্থাৎ যাদের কাছে সারা বছরের যাবতীয় খরচ বাদে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সমপরিমান সম্পদ থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০ কোটি লোক বসবাস করছে। এর মধ্যে শতকরা ৯০ জনই মুসলিম। এই অবস্থায় সরকারিভাবে জরিপ করলে বোঝা যেতো এদের মধ্যে কতজন লোক নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে এধরনের জরিপ কখনো হয়নি! তবে ২০১৬ সালের মে মাসের দিকে আজকের কাগজ পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে যাকাত আদায় ও বন্টনের একটি জরিপ করেছিল। তাদের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ন্যূনতম ২৫ হাজার কোটি টাকা যাকাত আদায় করে তা সুষ্ঠুভাবে বন্টন করা সম্ভব! কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে কখনো যাকাত বাবদ এত টাকা আদায় ও বন্টন হয়নি।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে,বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অনেক মুসলিম সমাজে দেখা যায় অনেক ধনীরা যারা নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক, কিন্তু তারা মালের সঠিক হিসাব না করে অনুমান উপর যাকাত আদায় করছে। আবার অনেকে আছে যাকাত আদায়ই করে না। আমাদের দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, প্রায় ৫২
বছর হতে চলছে। এই দীর্ঘ সময় যাবৎ দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু সম্পদশালীরা নিজেদের খ্যাতি অর্জনের জন্য প্রতি রমজান মাসে হাজার হাজার নর-নারীকে জড়ো করে তাদের মাঝে নগদ টাকাসহ শাড়ি-লুঙ্গি বিতরন করেন। এ সময় পদতলে পৃষ্ট হয়ে অনেক মানুষের মৃত্যুও ঘটে, যা অত্যান্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক!
বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, ১৯৮০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যাকাতের নগদ টাকা ও শাড়ী-লুঙ্গি নিতে গিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নিহত হয়েছে ২৫৪ জন এবং আহত হয়েছে অসংখ্য। এসব অনাকাংখিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে-যাকাতের নামে মানুষ মারার এই উৎসব কি ইসলাম সম্মত? না ইসলামের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক? প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামের চেতনা হলো-দরিদ্র ব্যক্তিকে সেই পরিমাণ যাকাতের টাকা দেওয়া, যেন দ্বিতীয়বার যাকাতের অর্থের জন্য তাকে কখনো হাত পাততে না হয়। এই প্রসঙ্গে খলিফা ওমর(রা.) বলেছেন, যখন তোমরা অসহায়কে যাকাত দিবে তখন তাকে ধনী বানিয়ে দাও। এই প্রসঙ্গে ইমাম নববী (রা.) আরো বলেছেন, অসহায়-গরীবদেরকে সেই পরিমান অর্থ দান কর, উক্ত সম্পদ দ্বারা তারা যেন অভাবের গ্লানি থেকে মুক্তি পায় এবং ধনী ব্যক্তির পার্যায়ে এসে উপনিত হয়।
এটা দুভার্গ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে যাকাতের প্রচলন একেবারেই নগন্য! অথচ এটি নামাজের মতো ফরজ ইবাদত। এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “তোমরা নামাজ আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে, তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।”(সুরা নূর:৫৬)
অনেকে হয়তো জানেন না যে, দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নামাজ আর সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিত ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যাকাত। পবিত্র কোরআনের প্রায় ৮০ জায়গায় নামাজের কথা এবং ৩২ জায়গায় যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এ দু`টো আমল তরক করার শাস্তি অনেক কঠিন।
যাকাত প্রদানের একটি বিশেষত্ব এই যে, এটি গোপনে দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহীত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা অনেক উত্তম। আর যদি গোপনে দান কর এবং অভাবগ্রস্তদের মাঝে দিয়ে দাও, তবে তা তোমদের জন্য আরও উত্তম।(সুরা বাকারা:২৭১)
যাকাত প্রদানের কারণে সম্পদ কোথাও জমা হয়ে থাকতে পারে না। অগনিত মানুষের হাতে পৌছে যায় যাকাতের অর্থ-সম্পদ। তারা তাদের চাহিদা পূরণে তা ব্যবহার করতে পারে এবং তারা প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদকে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারে। বিনিয়োগের কারণে সম্পদ এক জায়গায় পুঞ্জীভূক হয়ে থাকে না, বরং এর মাধ্যমে সম্পদ বাড়ে। ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে। এতে বাজারে চাহিদা বাড়ে। আর বাজরে চাহিদা বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে। আধুনিক অর্থনীতিবিদদের মতে, যেকোন বাজরে উৎপাদন বাড়লে পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়ে। ফলে সমাজ থেকে বেকারত্ব ও অভাব দূর হয়। তাদের মতে, ইসলামী বিধান অনুযায়ী যাকাত আদায় ও তার যথাযথ বন্টনের মাধ্যমে সমাজ থেকে স্থায়ীভাবে দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব।
যাকাত প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন শরিফে মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা নামাজ কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর, আর নিজেদের জন্য কল্যাণকর যা কিছু আগেভাগে পাঠাবে, তা আল্লাহর নিকট পাবে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের সব কাজকর্ম দেখছেন।(সুরা বাকারা:১১০) মূলত যাকাতের অধিকারী আট শ্রেণির মানুষ। এই বিষয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, যাকাত কেবল গরিব, মিসকিন এবং যাকাত আদায়ে নিযুক্তদের জন্য। যাদের ধর্মের প্রতি চিত্তাকর্ষন করা হয় তাদের জন্যও। দাসমুক্তি,ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথ ও মুসাফিরের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।(সুরা তওবা:৬০)
ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, যাকাত দেয়ার সময় মনে রাখতে হবে, আমর সম্পদের একটি নিদির্ষ্ট পরিমানের ওপর গরিবের হক আছে। আমি সে হক আদায় করছি মাত্র। বিষয়টি এমন, যাকাতদাতা হচ্ছেন দেনাদার আর গ্রহীতা হচ্ছেন পাওনাদার। পাওনাদারকে যেভাবে সম্মানের সঙ্গে অর্থ পরিশোধ করতে হয়; ঠিক তেমনিভাবেই যাকাতের অর্থও দরিদ্রকে বুঝিয়ে দিতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ ধনীরা যাকাত দেয় না। যাকাত দিলেও তা সঠিক হিসাব করে সঠিক লোকদের দেয় না। আর যারা যাকাত দেয় তাদের অধিকাংশই লোক দেখানো প্রচার সর্বস্ব দান করে। আমাদের দেশের ধনীরা যদি যথাযথভাবে যাকাত আদায় করতো, তাহলে ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ দারিদ্রমুক্ত হয়ে যেতো। ইসলামী বিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্র পক্ষ থেকে যাকাত আদায় এবং বন্টনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করার কথা। কিন্তু কোনো রাষ্ট্র যদি ইসলামী রাষ্ট্র না হয়, তাহলে সেখানে যাকাত দাতাদেরকে
নিজ উদ্যোগে উদ্ধৃত সম্পদের হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।
বস্তুত যাকাত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। ইসলামীচিন্তাবিদদের মতে,”ধনী ও গরীবের মাঝে বৈষম্য দূর করে ভ্রাতৃত্ব ও ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থার নাম-আর্থসামাজিক উন্নয়ন”। আর যাকাত আদায় ও সুষ্ঠু বন্টনের মাধ্যমেই এ ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এ ধরনের সমাজ আজ আমাদের কাছে স্বপ্নের সোনার হরিণ! আধুনিক ধনতান্ত্রিক বিশ্ব এধরনের স্বপ্নের সমাজের কথা কখনো কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এ ধরনের `সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সমাজ` উপহার দিয়েছিলো ইসলাম!!
অতি পরিতাপের বিষয় যে, পবিত্র কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য আর বাংলাদেশের যাকাত বন্টনচিত্র পুরো উল্টো। যাকাতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। দরিদ্র, অভাব, বেকার, অক্ষম জনরগোষ্ঠির আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ইসলামে যাকাতের বিধান। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, স্বনির্ভর দেশ গঠন যাকাতের প্রধান উদ্দেশ্য। দীর্ঘ বছর যাবৎ ধনীরা যাকাত দিয়ে যাচ্ছেন। আজন্ম দরিদ্র পরিবার যাকাত-ফেতরা কুড়িয়েই যাচ্ছেন। তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসছে না। তা হলে বাংলাদেশের চলমান ধারার যাকাত দারিদ্র বিমোচন করছে নাকি প্রতিবছর ধনীরা যাকাত বিলিয়ে দারিদ্রকে লালন করছেন? নাকি যাকাত প্রদানের নামে অসহায় ও গরীব মারার উৎসব পালন করছেন? নাকি নিজেদের খ্যাতি প্রকাশ করছেন?
এমতাবস্থায় বিবেকবান-বিত্তশালীদের কাছে বিশেষ অনুরোধ রইল-পরিকল্পিতভাবে ইসলামী বিধান অনুযায়ী অভাবী ও অসহায় ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যাকাত প্রদান করুন; যাতে দুই থেকে তিন বছর পর সেও যাকাত দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। এতে যাকাতের সুফল পাওয়া যাবে এবং দেশ ও সমাজ দারিদ্রমুক্ত ও বেকারমুক্ত হয়ে সুন্দর এবং কলাণমূলক রাষ্ট্রে পরিনত হবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ: deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized