![](https://www.deshdorshon.com/wp-content/uploads/2022/05/ukraine-112-20220310133937-750x420.jpg)
বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দরিদ্র দেশ। তবে ইদানিং উন্নয়নশীল দেশের স্তরে পৌঁছার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ বিশ্বের সামরিক জোটভুক্ত কোনো মহলের সদস্য নয়। অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের উপর `মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা` রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের থেকে রাশিয়ার দূরত্ব প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কিলোমিটার আর ইউক্রেনের দূরত্ব প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার। এত দূরে থেকেও পূর্ব ইউরোপীয় এই দুই দেশের দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের বাজারে তেল, গ্যাসসহ অন্যান্য অনেক খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে সুবিধাবাদি ব্যবসায়ীরা। এতে বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখানেই শেষ নয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন একটি অর্থনৈতিক যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। যার আরো কঠিন প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর। আমেরিকা, চীন বা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বছরে যে পরিমান আমদানি-রপ্তানি করে তার ১০ ভাগের ১ ভাগ করে রাশিয়ার সঙ্গে। আর ইউক্রেনের সঙ্গে তো আরো কম।
অংকের বিচারে মনে হতে পারে রাশিয়া-ইউক্রেনের এই যুদ্ধে বাংলাদেশের খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি তা নয়। এই যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন ও রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানি গ্যাস-তেলের দামের পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি অনেকে বেড়ে যেতে পারে।
জিডিপি আকার বিবেচনায় রাশিয়া পৃথিবীর ১১ তম দেশ। কিন্তু এই রাশিয়াই পৃথিবীর গম ও তুলার সবচেয়ে বড় উৎপাদন ও রপ্তানিকারক। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গম ও তুলা সরবরাহ করে রাশিয়া। আবার তেলের ক্ষেত্রে বলা হয় যে সারা দুনিয়ার ব্যবহৃত প্রতি ১০ ব্যারেল তেলের এক ব্যারেল উৎপাদিত হয় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তর জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়ায়। বাস্তবে ইউরোপের একটি বড় অংশ অচল হয়ে যাবে যদি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া তার গ্যাস ও তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
এমন পরাক্রমশালী রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে কিন্তু বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে আছে। রাশিয়া যে পরিমান গম, সার, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম বাংলাদেশে পাঠায়, তারচেয়ে বেশি বা প্রায় সমপরিমানের তৈরি পোশাক বাংলাদেশ থেকে নেয়। আর ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ মূলত গম আমদানি করে এবং রপ্তানি করে তৈরি পোশাক, যার পরিমান খুবই কম।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য; যার ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক। আর এ সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য। এই যুদ্ধের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে এই দুই দেশেরই বৈদেশিক বাণিজ্য দিন দিন বাড়ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনীতির এই যুদ্ধে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়াও এই যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ বর্তমানে স্থগিত হয়ে আছে। অথচ এর ৯০ ভাগ পুঁজিই রাশিয়ার!
এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নিমর্মতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রচুর লোক ইউক্রেন ত্যাগ করে প্রতিদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিচ্ছে। এই শরাণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ইউরোপের রাষ্টগুলির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এতো দিন উক্ত দেশগুলো যে তহবিল থেকে আমাদেরকে ঋন সহায়তা দিয়ে আসছিল, সেগুলো এখন হয়তো এই শরণার্থীদের পেছনেই ব্যয় হবে। সেটার কারণে হয়তো ডেভেলপমেন্ট ওয়াল্ডে অনেক দেশই আগামী বছরগুলোতে প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋন পাবে না।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের অর্ধেকের বেশি বা ৬৪ শতাংশ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এখন রাশিয়া যদি কোনো কারণে ইউরোপে তেল, গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তবে ইউরোপের অর্থনীতিতে একটি মন্দাভাব চলে আসতে পারে। এতে করে ইউরোপীয়দের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে এবং কমে যাবে বাংলাদেশে তাদের দেওয়া নতুন অর্ডারের পোশাকের মূল্য ও সংখ্যা। ফলে আবার ধস নামতে পারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়।
রাশিয়া ও বেলারুশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় পটাশ সার সরবরাহকারী দেশ। এখন রাশিয়া থেকে এই সার বাংলাদেশে আসা বন্ধ হয়ে গেলে এই মৌসুমে হয়তো তার কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে আগামী মৌসুমে বাংলাদেশে উক্ত সারের অভাব দেখা দিতে পারে এবং যার ফলে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যেতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম সরবরাহকারী এই দুই পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের সব গম সরবরাহকারী দেশ গমের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে শুরু করেছে এবং এর দাম হয়তো আরো বাড়বে। সুতরাং এই যুদ্ধের কারণে এখন সকল প্রকার জ্বালানি ও ভোগ্য পণ্যের দাম আন্তজার্তিক বাজারে দাম বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে যাবে এবং ঘাটতি আরো বেড়ে গিয়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যায়ন আরো কমে যাবে। সর্বোপরি আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম বাংলাদেশে অনেক বেড়ে যেতে পারে।
আজ প্রায় তিন মাস হতে চলছে, এই যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং সামনে আরো কঠিন সময় আসছে। এ সময়টা মোকাবিলা করতে সরকারকে বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান, জাহিদ হোসেন, আহসান এইচ মনসুর ও বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মো.তামিমের অভিমত হলো, বর্তমানে আমরা যেসব দেশ থেকে জ্বালানি তেল,গ্যাস, ভোজ্য তেল, গম ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানি করছি, সেসব দেশের সঙ্গে সুসস্পর্ক বজায় রাখা ও তাদের সাথে আমাদের একটা সমঝোতা তৈরি করা। এই প্রসঙ্গে তারা আরো বলেন, এখন সরকারকে দেশের বাজারে নজরদারি এবং আন্তর্জাতিক মহলে আরোবেশি দরকষাকষি উপর জোড় দিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে দীর্ঘমেয়াদী কোনো বিনিয়োগে যাওয়ার ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হওয়া।
এমতাবস্থায় জনগণ কোনো ধরনের সংকটে পড়তে পারে, তার আগাম বার্তা দেওয়া সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর সেই সংকট থেকে বাঁচার জন্য সরকারের তরফ থেকে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেটা ঘোষণা করাও সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। নইলে আঘাত যখন আসবে, তখন তা সামাল দেওয়া প্রস্তুতি থাকবে না। আর সেটা ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized